কুরআন এবং হাদিসের আলোকে মুনাফিকের আলামত ও নেফাকি থেকে বাঁচার উপায়

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে মুনাফিকের আলামত ও নেফাকি থেকে বাঁচার উপায়

মুনাফিকের আলামত এবং নেফাকি থেকে বাঁচার উপায় 

ইসলামী আক্বিদার মৌলিক বিষয় গুলো অকপটে স্বীকার করে অন্তরে বিশ্বাস করার নাম ঈমান। আর অস্বীকার করাকে বলা হয় কুফর। ঈমান এবং কুফরের মধ্যখানে একটি স্তর আছে, তা হল নিফাক অর্থাৎ মুনাফিকী। মুনাফিকরা অবিশ্বাসীদের চাইতে বেশি ভয়ংকর। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় অবিশ্বাসীদের চেয়ে মুনাফিকরাই ইসলামের বেশি ক্ষতি করেছে। অবিশ্বাসীরা ক্ষতি করে প্রকাশ্যে আর মুনাফিকরা ক্ষতি করে গোপনে। তাই তাদেরকে চেনা যায়না। এই কারনেই আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষ সতর্ক করেছেন।

মুনাফিকের পরিচয়।   আরবী নিফাক শব্দ থেকে মুনাফিক শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ হল দ্বি-মুখি স্বভাব বিশিষ্ট, বিশ্বাসঘাতক। অন্তরে কুফরি রেখে বাহ্যিক ইসলামী আচরণ প্রদর্শন করা। ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি সাধনকারী ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা হয়। ইঁদুরের গর্তের চোরা বাহির হওয়ার  পথকে আরবিতে না-ফিক্বা বলা হয়, যে পথে দিয়ে সে প্রয়োজনে লুকিয়ে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারে। মুনাফিক ব্যক্তিও নিজেকে বাঁচানোর জন্য এভাবে চোরা পথ ব্যবহার করে।

মুনাফিক চেনার উপায়।

ক। মুনাফিকরা আল্লাহ ও পরকালে অবিশ্বাস করে না

وَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَبِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَمَا ہُمۡ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ۘ

আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। (সূরা আল বাকারা ২:৮)

খ।  প্রদর্শনমূলক সৎকাজ করা

اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰہَ وَہُوَ خَادِعُہُمۡ ۚ  وَاِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوۡا کُسَالٰی ۙ  یُرَآءُوۡنَ النَّاسَ وَلَا یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰہَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۫ۙ

অবশ্যই মুনাফেকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুতঃ তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায়, একান্ত শিথিল ভাবে লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। (সূরা আন নিসা ৪:১৪২)

গ। প্রদর্শনীমূলক দান-খয়রাত করে

وَالَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمۡ رِئَآءَ النَّاسِ وَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَلَا بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ وَمَنۡ یَّکُنِ الشَّیۡطٰنُ لَہٗ قَرِیۡنًا فَسَآءَ قَرِیۡنًا

আর সে সমস্ত লোক যারা ব্যয় করে স্বীয় ধন-সম্পদ লোক-দেখানোর উদ্দেশে এবং যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে না, ঈমান আনে না কেয়ামত দিবসের প্রতি এবং শয়তান যার সাথী হয় সে হল নিকৃষ্টতর সাথী। (সূরা আন নিসা ৪:৩৮)

ঘ।  মুশরিকদের সাথে আন্তরিকতা এবং তাদেরকে পরামর্শদাতা হিসেবে গ্রহণ করা

اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا قَوۡمًا غَضِبَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ ؕ مَا ہُمۡ مِّنۡکُمۡ وَلَا مِنۡہُمۡ ۙ وَیَحۡلِفُوۡنَ عَلَی الۡکَذِبِ وَہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ

আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা মুসলমানদের দলভুক্ত নয় এবং তাদেরও দলভূক্ত নয়। তারা জেনেশুনে মিথ্যা বিষয়ে শপথ করে। (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮:১৪)

ঙ। ভালো কাজে বাঁধা দানকারী, মন্দ কাজে উৎসাহদাতা

اَلۡمُنٰفِقُوۡنَ وَالۡمُنٰفِقٰتُ بَعۡضُہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡضٍ ۘ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمُنۡکَرِ وَیَنۡہَوۡنَ عَنِ الۡمَعۡرُوۡفِ وَیَقۡبِضُوۡنَ اَیۡدِیَہُمۡ ؕ نَسُوا اللّٰہَ فَنَسِیَہُمۡ ؕ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ

মুনাফেক নর-নারী সবারই গতিবিধি একরকম; শিখায় মন্দ কথা, ভাল কথা থেকে বারণ করে এবং নিজ মুঠো বন্ধ রাখে। আল্লাহকে ভুলে গেছে তার, কাজেই তিনিও তাদের ভূলে গেছেন নিঃসন্দেহে মুনাফেকরাই নাফরমান। (সূরা আত তাওবাহ ৯:৬৭)

চ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দান

یَوۡمَ یَبۡعَثُہُمُ اللّٰہُ جَمِیۡعًا فَیَحۡلِفُوۡنَ لَہٗ کَمَا یَحۡلِفُوۡنَ لَکُمۡ وَیَحۡسَبُوۡنَ اَنَّہُمۡ عَلٰی شَیۡءٍ ؕ اَلَاۤ اِنَّہُمۡ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ

যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর তারা আল্লাহর সামনে শপথ করবে, যেমন তোমাদের সামনে শপথ করে। তারা মনে করবে যে, তারা কিছু সৎপথে আছে। সাবধান, তারাই তো আসল মিথ্যাবাদী। (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮:১৮)

ছ। হাদিসের দৃষ্টিতে মুনাফিকের তিনটি বিশেষ আলামত

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, মুনাফিকের চিহ্ন তিনটিঃ  

১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে;

২. যখন অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে এবং

৩. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৩)

জ। মুনাফিকরা তাদের শপথকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে

اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَہُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ فَلَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ

তারা তাদের শপথকে ঢাল করে রেখেছেন, অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। অতএব, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।(সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮:১৬)

ঝ। মুনাফিকরা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে 

اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَہُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ فَلَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ

তারা তাদের শপথকে ঢাল করে রেখেছেন, অতঃপর তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। অতএব, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮:১৬)

ঞ। মুনাফিকরা সলাতে উদাসীন

وَمَا مَنَعَہُمۡ اَنۡ تُقۡبَلَ مِنۡہُمۡ نَفَقٰتُہُمۡ اِلَّاۤ اَنَّہُمۡ کَفَرُوۡا بِاللّٰہِ وَبِرَسُوۡلِہٖ وَلَا یَاۡتُوۡنَ الصَّلٰوۃَ اِلَّا وَہُمۡ کُسَالٰی وَلَا یُنۡفِقُوۡنَ اِلَّا وَہُمۡ کٰرِہُوۡنَ

তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি অবিশ্বাসী, তারা নামাযে আসে অলসতার সাথে ব্যয় করে সঙ্কুচিত মনে। (সূরা আত তাওবাহ ৯:৫৪)

اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰہَ وَہُوَ خَادِعُہُمۡ ۚ  وَاِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوۡا کُسَالٰی ۙ  یُرَآءُوۡنَ النَّاسَ وَلَا یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰہَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۫ۙ

অবশ্যই মুনাফেকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুতঃ তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায়, একান্ত শিথিল ভাবে লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। (সূরা আন নিসা ৪:১৪২)

ট। ধর্মীয় পোশাকধারী

وَاِذَا رَاَیۡتَہُمۡ تُعۡجِبُکَ اَجۡسَامُہُمۡ ؕ وَاِنۡ یَّقُوۡلُوۡا تَسۡمَعۡ لِقَوۡلِہِمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ خُشُبٌ مُّسَنَّدَۃٌ ؕ یَحۡسَبُوۡنَ کُلَّ صَیۡحَۃٍ عَلَیۡہِمۡ ؕ ہُمُ الۡعَدُوُّ فَاحۡذَرۡہُمۡ ؕ قٰتَلَہُمُ اللّٰہُ ۫ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ

আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, তখন তাদের দেহাবয়ব আপনার কাছে প্রীতিকর মনে হয়। আর যদি তারা কথা বলে, তবে আপনি তাদের কথা শুনেন। তারা প্রাচীরে ঠেকানো কাঠসদৃশ্য। প্রত্যেক শোরগোলকে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে। তারাই শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হোন। ধ্বংস করুন আল্লাহ তাদেরকে। তারা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে ? (সূরা আল মুনাফিকুন ৬৩:৪)

ঠ। মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী

اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡہَدُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُ اللّٰہِ ۘ  وَاللّٰہُ یَعۡلَمُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُہٗ ؕ  وَاللّٰہُ یَشۡہَدُ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَکٰذِبُوۡنَ ۚ

মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (সূরা আল মুনাফিকুন ৬৩:১)

ড। ইসলাম বিরোধীদের নিকট বিচারপ্রার্থী

فَلَا وَرَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَیُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا

অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।  (সূরা আন নিসা ৪:৬৫)

ঢ। ইসলামী ব্যক্তিদের চরিত্র হননকারী

اِنَّ الَّذِیۡنَ جَآءُوۡ بِالۡاِفۡکِ عُصۡبَۃٌ مِّنۡکُمۡ ؕ لَا تَحۡسَبُوۡہُ شَرًّا لَّکُمۡ ؕ بَلۡ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ؕ لِکُلِّ امۡرِیًٴ مِّنۡہُمۡ مَّا اکۡتَسَبَ مِنَ الۡاِثۡمِ ۚ وَالَّذِیۡ تَوَلّٰی کِبۡرَہٗ مِنۡہُمۡ لَہٗ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্যে ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্যে রয়েছে বিরাট শাস্তি। (সূরা নূর ২৪:১১)

ণ। জিহাদকে ভয় করা

اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ قِیۡلَ لَہُمۡ کُفُّوۡۤا اَیۡدِیَکُمۡ وَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ ۚ فَلَمَّا کُتِبَ عَلَیۡہِمُ الۡقِتَالُ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ یَخۡشَوۡنَ النَّاسَ کَخَشۡیَۃِ اللّٰہِ اَوۡ اَشَدَّ خَشۡیَۃً ۚ وَقَالُوۡا رَبَّنَا لِمَ کَتَبۡتَ عَلَیۡنَا الۡقِتَالَ ۚ لَوۡلَاۤ اَخَّرۡتَنَاۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ؕ قُلۡ مَتَاعُ الدُّنۡیَا قَلِیۡلٌ ۚ وَالۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لِّمَنِ اتَّقٰی ۟ وَلَا تُظۡلَمُوۡنَ فَتِیۡلًا

তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জেহাদের নির্দেশ দেয়া হল, তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে একদল লোক মানুষকে ভয় করতে আরম্ভ করল, যেমন করে ভয় করা হয় আল্লাহকে। এমন কি তার চেয়েও অধিক ভয়। আর বলতে লাগল, হায় পালনকর্তা, কেন আমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করলে! আমাদেরকে কেন আরও কিছুকাল অবকাশ দান করলে না। ( হে রসূল) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর আখেরাত পরহেযগারদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের অধিকার একটি সূতা পরিমান ও খর্ব করা হবে না। (সূরা আন নিসা ৪:৭৭)

ত। ঈমানদারদের বিপদে খুশী হয়

اِنۡ تَمۡسَسۡکُمۡ حَسَنَۃٌ تَسُؤۡہُمۡ ۫  وَاِنۡ تُصِبۡکُمۡ سَیِّئَۃٌ یَّفۡرَحُوۡا بِہَا ؕ  وَاِنۡ تَصۡبِرُوۡا وَتَتَّقُوۡا لَا یَضُرُّکُمۡ کَیۡدُہُمۡ شَیۡـًٔا ؕ  اِنَّ اللّٰہَ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ مُحِیۡطٌ 

তোমাদের যদি কোন মঙ্গল হয়; তাহলে তাদের খারাপ লাগে। আর তোমাদের যদি অমঙ্গল হয় তাহলে আনন্দিত হয় আর তাতে যদি তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনই ক্ষতি হবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে সে সমস্তই আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে। (সূরা আলে ইমরান ৩:১২০)

নেফাকী থেকে বাঁচার উপায়।

একজন মুসলিম নিজকে মুনাফিকী থেকে পূতপবিত্র রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই সদগুণাবলী ও সৎকর্মে বিভূষিত হতে হবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরা হল :

ক। তাকবীরে তাহরীমার সাথে সলাত আদায়

مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا فِى جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيْرَةَ الأُوْلَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ.

 

যে ব্যক্তি প্রথম তাকবীর প্রাপ্তিসহ একাধারে চল্লিশ দিন (পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত) জামাআতে আদায় করবে তার জন্য দুটি মুক্তিপত্র লিখে দেওয়া হবে। একটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি, দ্বিতীয়টি মুনাফিকী থেকে মুক্তি। (তিরমিযী হা/২৪১)

খ। কাফেরদের আনুগত্য না করা

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْماً حَكِيْماً.

হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য কর না। অবশ্যই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (সূরা আল আহযাব ৩৩/১)

গ। মুনাফিকদের উপেক্ষা করা

أُولَـئِكَ الَّذِيْنَ يَعْلَمُ اللهُ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيْغاً .

ঐ মুনাফিকরাই তো তারা, যাদের অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি ওদের এড়িয়ে চল বা উপেক্ষা কর, ওদের উপদেশ দাও এবং ওদের এমন কথা যা মর্মে গিয়ে পৌঁছে (সূরা আন নিসা ৪/৬৩)

ঘ।মুনাফিকদের সঙ্গে বিতর্কে না জড়ানো

وَلاَ تُجَادِلْ عَنِ الَّذِيْنَ يَخْتَانُوْنَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّاناً أَثِيْماً.

যারা নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে পসন্দ করেন না (সূরা আন নিসা ৪/১০৭)

ঙ। মুনাফিকদের প্রতি অবজ্ঞা দেখান এবং তাদের নেতা না বানানো

عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُولُوْا لِلْمُنَافِقِ سَيِّدٌ فَإِنَّهُ إِنْ يَكُ سَيِّدًا فَقَدْ أَسْخَطْتُمْ رَبَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ.

বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা কোন মুনাফিককে সাইয়্যিদ বা নেতা নামে আখ্যায়িত করো না। কেননা সে যদি সত্যিই (তোমাদের) নেতা হয়, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রভুকে ক্ষুব্ধ করবে। (আবু দাঊদ হা/৪৯৭৭)

চ। মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ না করা

وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَداً وَلاَ تَقُمْ عَلَىَ قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَمَاتُوْا وَهُمْ فَاسِقُوْنَ.

তাদের (মুনাফিকদের) কেউ মারা গেলে তুমি কখনও তার জানাযার ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং পাপাচারী অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে (সূরা আত তওবা ৯/৮৪)

ছ। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা 

مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِّفَاقٍ 

যে ব্যক্তি যুদ্ধ-জিহাদ না করে অথবা নিজের মনে যুদ্ধ-জিহাদের সংকল্প না করে মারা যাবে, সে মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মারা যাবে। (সহিহ মুসলিম হা/১৯১০)

সমাপনি

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা আলা আমাদের সকলকে নেফাকি থেকে বেঁচে থাকার তাউফিক দান করুন। আমিন 

প্রিয়নবী (সাঃ) এর বয়স ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত জীবনী


মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিবিজড়িত দিন।

আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত ভালোবেসে, পছন্দ করে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হিসেবে দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কালের বিবর্তনে মানুষ হেদায়েতের পথ ভুলে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পশুত্বের পর্যায়ে নেমে আসে। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও পণ্য সামগ্রীর মত বাজারে বিক্রি হতো।  নারী জাতি ছিল বিনোদনের উপকরণ। দিন রাতে সমান ভাবে চলতো হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও মদ্যপান। বসতো  জুয়ার আসর। সামান্য বিষয় নিয়ে দীর্ঘকালব্যাপী লড়াই শুরু হতো।

এ অন্ধকার পুরীতে আলো জ্বালাতে, অশান্তির দাবানল নিভিয়ে দিতে, মানুষকে মানুষের মর্যাদার আসন দিতে, নারীজাতিকে সম্মানের আসনে বসাতে পৃথিবীতে আগমন করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব রহমাতুল্লিল আলামিন।

জন্ম

৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে ১২-ই রবিউল আউয়াল মাসে রোজ সোমবার কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখায় বিশ্ব শান্তির মহানায়ক সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক সমগ্র মানব জাতির নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমেনা

মহানবী (সাঃ) এর ৬৩ বছর জীবনের বিভিন্ন পরিক্রমা

১ থেকে ৫ বছর বয়স

জন্মের প্রথম পাঁচ দিন নিজ মাতার দুগ্ধপান এবং পরবর্তী দুই বছর বয়স পর্যন্ত আরবীয় বেদুইন মহিলা বিবি হালিমার একটি স্তন থেকে দুধ পান করতেন, অন্যটি তার দুধ ভাই আব্দুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন। এতে শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) এর চরিত্রে ইনসাফ ও ত্যাগের একটি অনুপম দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। বিবি হাওয়ার গৃহে প্রথম পাঁচটি বছর তিনি লালিত পালিত হয়।

৬ষ্ঠ বছর বয়স

নানার বাড়ি মদিনা থেকে ফেরার পথে মাতার ইন্তেকাল হওয়ার মাধ্যমে তিনি এতিম হলেন।

৬ থেকে ৮ বছর বয়স

৬ থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত দাদা আবদুল মুত্তালিব এর ইন্তেকাল এবং তার চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। তিনি চাচার অস্বচ্ছল পরিবারে মেষ-ছাগল চরাতেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সাহায্য করতেন।

১২  বছর বয়স

চাচার সাথে সিরিয়াতে বাণিজ্যের জন্য গমন করেন এবং শত্রুরা তাঁর অনিষ্ট করতে পারেন পাদ্রী বুহাইরার এমন কথা মতে তিনি মক্কায় ফেরত আসলেন

১৪ বছর বয়সঃ

১৪ বছর বয়সে তিনি ওকাজ মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী ফিজার যুদ্ধে (অন্যায় সমর) জানমালের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি অবলোকন করেন এবং হিলফুল ফুজুল (শান্তি সংঘ) প্রতিষ্ঠা করেন। যার উদ্দেশ্য ছিলঃ

(ক) আর্তমানবতার সেবা

(খ) অত্যাচারীকে প্রতিরোধ

(গ) অত্যাচারিতকে সাহায্য করা

(ঘ) সমাজে শান্তিওসম্প্রীতি বজায় রাখা

এই শান্তি মিশনে সফল হয়ে তিনি কৈশোর বয়সে আলামিন উপাধি লাভ করেন।

২৪ বছর বয়স

হযরত খাদিজা (রাঃ) এর  ব্যবসা-বাণিজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন এতে খাদিজা তাঁর প্রতি মুগ্ধ হন।

২৫ বছর বয়স

২৫ বছর বয়সে তিনি হযরত খাদিজা (রাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেন এবং চাচার সহায়তায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন খাদিজার (রাঃ) বয়স ৪০ বছর ছিল।

২৬ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়স

কাবাঘর পূর্ননির্মাণ, হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করে সঙ্ঘাতময় অবস্থা থেকে মক্কাবাসীকে মুক্তিদান ও অন্যান্য সমাজ সংস্কারমূলক কাজ করেন।

৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়স

সমাজ চিন্তা ও জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে হেরা পর্বতে ধ্যান মগ্ন থাকা অবস্থায় ওহী প্রাপ্ত হন। সূরা আলাকের ১ থেকে ৫ আয়াত নাযিল হয়।

৪১ থেকে ৪৫ বছর বয়স

গোপনে ইসলাম প্রচার। হযরত খাদিজা (রাঃ), হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) সহ ৪০ জনের ইসলাম গ্রহণ।

৪৬ থেকে ৪৯ বছর বয়স

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার। হযরত হামজা (রাঃ) ও হযরতওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ।

৫০ বছর বয়স

মহানবী (সাঃ) এর শোকের বছর। চাচা আবু তালিব ও খাদিজার (রাঃ) ইন্তেকাল।

৫১ বছর বয়স

মহানবীর সাল্লাহু সালাম তায়েফ গমন করেন এবং নির্যাতনের শিকার হন।

৫২ বছর বয়স

মহানবী (সাঃ) কে সান্তনা দেওয়া এবং সাক্ষাত করে ধন্য করার জন্য আল্লাহ তাঁকে মিরাজেগমন করান এবং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হয়।

৫৩ থেকে ৫৪ বছর বয়স

কুরাইশদের সীমাহীন অত্যাচারে মদিনা হিজরত ও ৪৭টি ধারা সম্বলিত মদিনা সনদ। প্রথম লিখিত সংবিধান যাতে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শান্তি সম্প্রীতি বিধান রয়েছে। যুদ্ধের আয়াত নাযিল। প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি।

৫৫ থেকে ৬০ বছর বয়স

বদর, উহুদ, খন্দক, খয়বর, হুদায়বিয়ার সন্ধি সহ বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালনা।উহুদে দানদান মোবারক শহীদ হওয়া।

৬১ থেকে ৬২ বছর বয়স

১০ হাজার সাহাবী নিয়ে বিনাবাধায় মক্কা বিজয় করেন। কাবা ঘর থেকে ৩৬০ টি মূর্তি উচ্ছেদ করেন এবং তখন হতে হজ্জ্ব ফরজ হয়।

৬৩ বছর বয়স

১ লক্ষ ১৪ হাজার সাহাবী নিয়ে বিদায় হজ সম্পন্ন করে মদিনায় ফিরে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে জ্বর ও মাথা ব্যাথা বৃদ্ধি পায়। তার ১৪ দিন পর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ইন্তেকাল করেন।

রাসুল এর সন্তানাদি

তিনি তিন পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ

তিনি ছোট-বড় প্রায় ৮৫ টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রায় মতান্তরে ১৯ টি যুদ্ধের সেনাপতি দায়িত্ব পালন করেন।

উপসংহার

কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা তাকে রহমাতুল্লিল আলামিন (সমগ্র জগতের রহমত), সাইয়েদুল মুরসালিন (সমস্ত নবীদের সরদার), উসওয়াতুন হাসানাহ (উত্তম আদর্শ ও চরিত্রের অধিকারী) বলে উল্লেখ করেছেন। দুনিয়াতে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সিরাজুম মুনিরা (হেদায়েতের সুস্পষ্ট প্রদীপ) হিসেবে।

তিনি সমাজ থেকে অন্যায়,অনাচার, অসত্য, অন্ধকার দূরীভূত করে সত্য-সাম্য ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গড়ে গেছেন মানবজাতির জন্য। তার ৬৩ বছরে সংক্ষিপ্ত জীবনের অনুপম শিক্ষা ও জীবন আদর্শ আমাদের ধর্মীয়, পার্থিব ও সামরিক জীবনে অনুসরণের মাধ্যমে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর (সাঃ)শিক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে পরবর্তী দিনগুলো অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন।

পিডিএফ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন