রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলাম |
সুস্থতা ও অসুস্থতা
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তাতে আনুগত্য ও নাফরমানির কোনো সম্পর্ক নেই। নবী-রাসুলরাও
অসুস্থ হয়েছেন। যাঁরা ছিলেন সব মাখলুকের সেরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব পয়গম্বরের চেয়ে
শ্রেষ্ঠ। তিনিও কয়েকবার অসুস্থ হয়েছেন। তাঁকেও অসুস্থতার কষ্ট বরদাশত করতে হয়েছে। এটি
আবশ্যক নয় যে অসুস্থতা আল্লাহর শাস্তি ও তাঁর অসন্তুষ্টির দলিল। অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ
থেকে পরীক্ষাস্বরূপ হতে পারে। মুমিনের জন্য তার গুনাহর কাফফারাও হতে পারে। নবীজি (সা.)
বলেছেন,
রোগ বালাই বিপদ মুমিনের গুনাহের কাফফারা
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ لَمَّا نَزَلَتْ :
(مَنْ يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ ) شَقَّ ذَلِكَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ
فَشَكَوْا ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ "
قَارِبُوا وَسَدِّدُوا وَفِي كُلِّ مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ كَفَّارَةٌ حَتَّى
الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا أَوِ النَّكْبَةِ يُنْكَبُهَا " . ابْنُ
مُحَيْصِنٍ هُوَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ مُحَيْصِنٍ . قَالَ أَبُو
عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ .
আবূ হুরাইরাহ্
(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, “কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে পাবে”- (সূরা আন –নিসা ১২৩) আয়াত অবতীর্ণ হলে মুসলিমদের নিকট বিষয়টি খুবই গুরুতর মনে হয়। তাই তারা
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) এর নিকট এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন।
তিনি বললেনঃ তোমরা সত্যের নিকটবর্তী থাক এবং সরল সোজা পথ তালাশ কর। মু’মিনের প্রতিটি বিপদ-মুসীবত
ও কষ্ট-ক্লেশ, এমনকি তার দেহে কোন কাঁটা বিদ্ধ হলে
বা তার উপর কোন আকস্মিক বিপদ এলে তার দ্বারাও তার গুনাহ্র কাফ্ফারা (ক্ষতিপূরণ) হয়ে
যায়।
(জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩০৩৮)
অসুস্থতা দ্বারা
মুমিন বান্দার স্তর উন্নত হয়। অসুস্থতাকে অশুভ নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়।
وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله
صلى الله عليه وسلم " من يرد الله به خيراً يصب منه" : (رواه
البخاري).
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলেন।
(সহীহুল বুখারী ৫৬৪৫, আহমাদ ৭১৯৪, মুওয়াত্তা মালেক ১৭৫২, রিয়াদুস সলেহিন ৪০)
ইসলাম রোগব্যাধি
থেকে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে Prevention
is better than cure রোগ প্রতিরোধ রোগ
নিরাময় থেকে শ্রেয়। এ কথাও বলা যায়, ‘Prevention is
cheaper than cure’ রোগ প্রতিরোধ নিরাময়ের
চেয়ে সস্তা। এ কারণেই ইসলাম এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।
রোগ বালাই প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ
রোগ প্রতিরোধে
অজু / পবিত্রতা
অজুর মধ্যে আল্লাহতায়ালা
অনেক নেয়ামত দিয়েছেন। অজু করার বিষয়ে আল্লাহ সূরা মায়িদায় বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ
اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡہَکُمۡ وَاَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ
وَامۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ وَاَرۡجُلَکُمۡ اِلَی الۡکَعۡبَیۡنِ ؕ وَاِنۡ
کُنۡتُمۡ جُنُبًا فَاطَّہَّرُوۡا ؕ وَاِنۡ کُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ
اَوۡ جَآءَ اَحَدٌ مِّنۡکُمۡ مِّنَ الۡغَآئِطِ اَوۡ لٰمَسۡتُمُ النِّسَآءَ
فَلَمۡ تَجِدُوۡا مَآءً فَتَیَمَّمُوۡا صَعِیۡدًا طَیِّبًا فَامۡسَحُوۡا
بِوُجُوۡہِکُمۡ وَاَیۡدِیۡکُمۡ مِّنۡہُ ؕ مَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیَجۡعَلَ عَلَیۡکُمۡ
مِّنۡ حَرَجٍ وَّلٰکِنۡ یُّرِیۡدُ لِیُطَہِّرَکُمۡ وَلِیُتِمَّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکُمۡ
لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা
অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে
অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র
মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায়
ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান
এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।
(সূরা মায়িদা ৫:৬)
বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার
পাশাপাশি প্রচুর সওয়াব রয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অজু থাকা সত্ত্বেও নতুন অজু করে সে দশটি নেকি লাভ
করে।’
অজুর বরকতে বান্দার
অতীত জীবনের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। অজুকারী ব্যক্তি হাশরের ময়দানে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত
হবেন। অজুকারীদের অনেকে দুনিয়াতে জান্নাতের সু-সংবাদ পেয়েছেন। অজু শেষে কালেমা শাহাদাত
পাঠকারী ব্যাক্তির জন্য জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া অজুর শুরুতে
কবজি পর্যন্ত দুই হাত ধোয়া, কুলি করা, মিসওয়াক করা, কান ও নাকের বহির্ভাগ পরিষ্কার করাকে নবী করিম (সা.) সুন্নত হিসেবে অনুসরণ করতে
বলেছেন।
রোগ
প্রতিরোধে শরীর চর্চা
শারীরিক শক্তি বর্ধনে এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ জরুরি। এর পাশাপাশি ব্যায়াম ও শরীরচর্চারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ জন্য শারীরিক পরিশ্রম, সাঁতার কিংবা কুস্তিগিরি কৌশল রপ্ত করা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। একই ধারাবাহিকতা ছিল নবী-সাহাবির যুগেও। পবিত্র কোরআনে মুমিনদের দৈহিক ও সামরিক শক্তির অনুশীলন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
وَاَعِدُّوۡا لَہُمۡ مَّا اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ قُوَّۃٍ
وَّمِنۡ رِّبَاطِ الۡخَیۡلِ تُرۡہِبُوۡنَ بِہٖ عَدُوَّ اللّٰہِ وَعَدُوَّکُمۡ
وَاٰخَرِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ ۚ لَا تَعۡلَمُوۡنَہُمۡ ۚ اَللّٰہُ یَعۡلَمُہُمۡ ؕ
وَمَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ یُوَفَّ اِلَیۡکُمۡ
وَاَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
আর প্রস্তুত কর তাদের
সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং
পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর
শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে
তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা
কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না।
(সূরা আনফাল ৮:৬০)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়।
’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৪)
এ ছাড়া হাঁটাহাঁটি
করা শরীরচর্চার একটি মাধ্যম। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) দ্রুত হাঁটতেন। আবার কখনো কখনো
দৌড় প্রতিযোগিতাও করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজির চেয়ে দ্রুতগতিতে কাউকে হাঁটতে দেখিনি। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬৪৮)
দৌড় দেওয়া শরীরচর্চার
একটি মাধ্যম। মহানবী (সা.) আয়েশা (রা)-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন।
আয়েশা (রা.) নিজেই বলেছেন, ‘নবী করিম (সা.) দৌড়ে আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করলেন। তখন আমি আগে বেরিয়ে গেলাম।
পরে যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গেল, তখন রাসুল (রা.)
আমার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করে আমাকে হারিয়ে দিলেন এবং তিনি বলেন, এবার আগেরবারের বদলা নিলাম। ’ (মুসনাদ আহমদ ও আবু দাউদ)
কুস্তি ও শারীরিক
কসরত করাও ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ। নবী করিম (সা.) রুকানা নামক এক নামকরা কুস্তিগিরের
সঙ্গে লড়েছিলেন। সে ছিল খুবই বলিষ্ঠ। মহানবী (সা.) একাধিকবার তাকে পরাজিত করেছিলেন।
(আবু দাউদ)
সুস্থ দেহের জন্য
শারীরিক পরিচর্যার পাশাপাশি হাসিখুশি থাকা ও মানসিক প্রফুল্লতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
নবীজি (সা.) নিজেও অত্যন্ত সদালাপী ও হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীর অধিকারী ছিলেন। সাহাবিরা
বলতেন,
আমরা রাসুল (সা.)-এর চেয়ে হাসিখুশি আর কাউকে দেখিনি। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬৪১)
প্রথম পর্ব রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ (১)
দ্বিতীয় পর্ব রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ (২)