রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ (পর্ব ০২)

রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলাম

 পরিমিত আহার গ্রহণে ইসলামের নির্দেশনা

সুস্থতা মহান আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য সুস্থতা একান্ত প্রয়োজন। সুস্থতার মূল্যায়ন, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। সতর্কতা সত্ত্বেও রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে এর সুচিকিৎসায় জোর দিয়েছে।

পরিমিত আহার সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে,

عَنْ أُمِّهَا، أَنَّهَا سَمِعَتِ الْمِقْدَامَ بْنَ مَعْدِيكَرِبَ، يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ يَقُولُ ‏ "‏ مَا مَلأَ آدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ حَسْبُ الآدَمِيِّ لُقَيْمَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ فَإِنْ غَلَبَتِ الآدَمِيَّ نَفْسُهُ فَثُلُثٌ لِلطَّعَامِ وَثُلُثٌ لِلشَّرَابِ وَثُلُثٌ لِلنَّفَسِ ‏"‏ ‏.‏

মিকদাম বিন মাদীকারিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি: মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। (যতটুকু খাদ্য গ্রহণ করলে পেট ভরে পাত্র থেকে ততটুকু খাদ্য উঠানো কোন ব্যক্তির জন্য দূষণীয় নয়)। যতটুকু আহার করলে মেরুদণ্ড সোজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই কোন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোন ব্যক্তির নফস (প্রবৃত্তি) জয়জুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৩৪৯

এশার আগে রাতের খাবার

রাতের খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে পাকস্থলী শয়ন অবস্থায়ও কর্মরত থাকে। ফলে পরিপাকের ত্রুটিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি হতে পারে। তাই এশার নামাজের আগে রাতের খাবার খেয়ে নিলে একদিকে মসজিদে যাওয়া-আসা, নামাজ আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে ঘুমানোর আগেই পাকস্থলীর কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়, অন্যদিকে এশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো সম্ভব হয়, যা সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এশার নামাজের আগে ঘুমাননি এবং তার পর নৈশ আলাপ করেননি। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭০২)

অন্য হাদিসে এসেছে,

 عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ إِذَا وُضِعَ عَشَاءُ أَحَدِكُمْ وَأُقِيمَتِ الصَّلاَةُ فَابْدَءُوا بِالْعَشَاءِ وَلاَ يَعْجَلَنَّ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْهُ ‏"‏ ‏.

আবদুল্লাহ ইবনু 'উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের কারো সামনে রাতের খাবার এসে গিয়েছে সলাতের ইক্বামাত হয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থা হলে সে খাবার দিয়েই শুরু করবে। (অর্থাৎ- প্রথমে খাবার খেয়ে নিবে) আবার খাবার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সলাতের জন্য ব্যস্ত হবে না। (ই.ফা. ১১২৪, ই.সে. ১১৩৩)

সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১১৩১

সাপ্তাহিক ও মাসিক রোজা

হাদিসে এক দিন পর পর অথবা সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার নির্দেশনা আছে। মাসে তিন দিন রোজা রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রোজার মাধ্যমে শরীরে অটোফেজির সুযোগ তৈরি হয় এবং পাকস্থলীর দূষিত পদার্থ পরিষ্কার হয়ে যায়। এক দিন পর পর রোজা রাখাকে সাওমে দাউদ বলা হয়। দাউদ (আ.) এভাবে রোজা রাখতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটিকে সর্বোত্তম রোজা বলেছেন এবং বেশি রোজা রাখতে আগ্রহীদের এভাবে রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা রাসুলুল্লাহ (সা.) পছন্দ করতেন। এ ছাড়া তিনি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা আদায় করাকে বছরজুড়ে রোজা রাখার সমতুল্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সপ্তাহের প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার ব্যাপারে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার (বান্দার) আমল (আল্লাহর দরবারে) উপস্থাপিত হয়। আমি পছন্দ করি যে রোজা অবস্থায় আমার আমল উপস্থাপিত হোক। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৪৭)

স্বাস্থ্যসম্মত আহার গ্রহণে ইসলামি দৃষ্টিকোণ

স্বাস্থ্য আল্লাহর এক অশেষ দান ও অনুগ্রহ। মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে তাকে অবশ্যই শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সব সময় নিয়মিতভাবে শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে অসুস্থ হলে অবশ্যই তাকে কিয়ামতের দিন এ জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সুস্থ থাকাকে ইসলাম অধিক উৎসাহিত করেছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন বান্দাকে নিয়ামত সম্পর্কে প্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে, সেটা হলো তার সুস্থতাবিষয়ক। তাকে বলা হবে, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি? (তিরমিজি)।

প্রত্যেক মোমিনের কর্তব্য হলো, সর্বদা শরীর ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকা। একজন মোমিন প্রথমত খেয়াল রাখবেন, তিনি যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে না পড়েন এবং কখনো অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে কোনো অলসতা বা শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। নবী করিম (সা.) সাহাবিদের দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি নিজে অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা মহান আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে, যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তা হলো বার্ধক্য। (আবু দাউদ)। অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করা ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা রোগ দেন, রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেন। প্রতিটি রোগের চিকিৎসা রয়েছে। (জাদুল মাআদ)।


প্রথম পর্ব রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ (১)

দ্বিতীয় পর্ব রোগ-বালাই ও মহামারী প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিকোণ (২)