ইসলামের আলোকে ইন্টারনেটের নৈতিক ব্যবহার: গাইডলাইন ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ । মুহাঃ আবুবকর ছিদ্দিক
![]() |
ইসলামের আলোকে ইন্টারনেটের নৈতিক ব্যবহার |
ইন্টারনেট আধুনিক
সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যা জ্ঞান, যোগাযোগ ও সেবার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে।
তবে ইসলামের দৃষ্টিতে এর ব্যবহার হতে হবে নৈতিক ও দায়িত্বশীল। ইসলাম সর্বদা সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের পথে চলার নির্দেশ দেয়। ইন্টারনেটে গীবত, অপপ্রচার, অশ্লীলতা বা সময়ের
অপচয় ইসলামী নীতিমালার পরিপন্থী। অন্যদিকে, সত্য প্রচার, জ্ঞান বিতরণ ও সৎকাজে
সহযোগিতা ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহারের উদাহরণ।
ইন্টারনেট ও সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সময় আমাদের অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আমরা কি এমন কোনো কনটেন্ট দেখছি বা শেয়ার করছি যা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী? নাকি এটি জ্ঞান অর্জন, সৎ কাজে সহযোগিতা বা দীন প্রচারের মাধ্যম হয়ে উঠছে? প্রতিটি ক্লিক, লাইক ও শেয়ারের আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন—এটি কি আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য?
ইন্টারনেটের সঠিক
ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা ইবাদাতের সুযোগ বাড়াতে পারি, যেমন ইসলামিক জ্ঞান অর্জন, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ
করা বা অসহায় মানুষকে সাহায্য করা। অন্যদিকে, সময় নষ্ট করা, গিবত বা হারাম কনটেন্টে
জড়ানো থেকে বিরত থাকাই ঈমানদারের দায়িত্ব। মনে রাখবেন, এই ডিজিটাল মাধ্যমও কিয়ামতে আমাদের আমলের অংশ হবে। তাই আল্লাহর
সন্তুষ্টি ও জবাবদিহিতার চেতনায় ভার্চুয়াল জীবনকে গড়ে তুলুন।
ইন্টারনেট ব্যবহারের নৈতিক
নির্দেশনা
১। ইন্টারনেট
ব্যবহারকে সৎকর্ম পরিণত
করা
মানুষের জীবনে প্রতিটি কাজেরই দুইটি দিক রয়েছে। ভালো এবং খারাপ ভালো হলেতো ভালোই। কিন্তু যদি ভালো না হয়,
তবে অন্তত এতটুকু ক্ষতি যে,
তাতে সময় নষ্ট হচ্ছে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে মুমিন ব্যক্তির একটা পরিচয় হল সে অযথা কাজ থেকে বিরত থাকে। যেমন সূরা মুমিনুন এ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ
مُعۡرِضُوۡنَ
আর যারা অনর্থক কথাকর্ম
থেকে বিরত থাকে। (আল-মুমিনুন ২৩:৩)
২।
সত্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্য শেয়ার করা
ইন্টারনেটে কোনো
তথ্য শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করা ইসলামী দায়িত্ব। ভুল বা গুজব ছড়ানো থেকে
বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ
فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا
فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
হে ঈমানদারগণ! যদি
কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা যাচাই করে নাও; অন্যথায় অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করবে,পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে।" (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:৬)
হাদিস শরিফে
এসেছে,
مَنْ
حَدَّثَ بِحَدِيثٍ فَأَعْجَبَهُ فَهُوَ كَذَّابٌ
যে ব্যক্তি কোনো কথা শুনে (যাচাই ছাড়া) তা প্রচার করে,সে মিথ্যাবাদী হিসেবে যথেষ্ট। (সহীহ মুসলিম
৫)
৩।।
অন্যের গীবত ও অপবাদ থেকে দূরে থাকা
সামাজিক মাধ্যমে
কারো সম্মানহানি, গীবত বা অপপ্রচার
করা হারাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
أَيُحِبُّ
أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ
তোমাদের কেউ কি তার
মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো
একে ঘৃণাই কর। (সুরা আল-হুজরাত
৪৯:১২)
الْغِيبَةُ
أَشَدُّ مِنَ الزِّنَا
গীবত (পরনিন্দা)
ব্যভিচার থেকে বেশি গুরুতর। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৫৭৬৩)
৪। সময় নষ্ট না করা
ইন্টারনেটে অতিরিক্ত
সময় ব্যয় করে প্রয়োজনীয় ইবাদত,কাজ বা পরিবারের
অধিকার নষ্ট করা অনুচিত। রাসূল (সা.) সময়ের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব দিয়েছেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
نِعْمَتَانِ
مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
দুটি নিয়ামত সম্পর্কে
অধিকাংশ মানুষ গাফেল: সুস্থতা ও অবসর সময়। (সহীহ বুখারী ৬৪১২)
সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর একটা প্রসিদ্ধ হাদিস।
عَنْ
ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ﷺ:«اغْتَنِمْ
خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ،
وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ
مَوْتِكَ»
ইবন আব্বাস
(রাঃ) থেকে বর্ণিত,নবী করীম ﷺ বলেছেন: পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটির
আগে গনিমত (সুযোগ) হিসেবে গ্রহণ করো: তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের আগে,তোমার সুস্থতাকে
অসুস্থতার আগে,তোমার সম্পদকে দারিদ্র্যের আগে,তোমার অবসরকে
ব্যস্ততার আগে,এবং তোমার জীবনকে মৃত্যুর আগে। (আল-মুস্তাদরাক হাদীস নম্বর:
৭৮৪৬)
৫। প্রাইভেসি রক্ষা করা
কারো ব্যক্তিগত তথ্য,ছবি বা বার্তা অনুমতি ছাড়া শেয়ার করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা
বলেন,
وَلَا
تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا
একে অপরের গোপনীয়
বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং পরনিন্দা করো না। (সূরা আল-হুজরাত ৪৯:১২)
৬। সাইবার বুলিং ও উস্কানিমূলক আচরণ
ত্যাগ করা
কাউকে হেয়প্রতিপন্ন
করা,
বিদ্রূপ করা বা ঘৃণা ছড়ানো ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী। আল্লাহ রাব্বুল
আলামিন বলেন,
وَيْلٌ
لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
ধ্বংস প্রত্যেক পিছনে
নিন্দাকারী, সমালোচনাকারীর জন্য। (সূরা আল-হুমাযাহ ১০৪:১)
৭। দাওয়াত ও সৎকাজের প্রচার
ইন্টারনেটকে ইসলামের
সঠিক বার্তা, জ্ঞান ও সৎকাজ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে
ব্যবহার করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
بَلِّغُوا
عَنِّي وَلَوْ آيَةً
তোমরা আমার পক্ষ থেকে (জ্ঞান) পৌঁছে দাও—এমনকি যদি তা একটি আয়াতও হয়। (বুখারী-৩২১৫)
৮। ভাষা ও আচরণে শালীনতা বজায় রাখা
অশালীন ভাষা, গালাগালি বা অহেতুক তর্কে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা
বলেন,
وَقُل
لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
আর আমার বান্দাদেরকে
বলো,
তারা যেন উত্তম কথা বলে। (সূরা আল-ইসরা
১৭:৫৩)
৯। অনৈতিক ও হারাম কন্টেন্ট এড়ানো
পর্নোগ্রাফি,অশ্লীলতা বা নিষিদ্ধ বিষয়ে কন্টেন্ট দেখা বা শেয়ার করা থেকে
সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ
آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ
وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর আল্লাহ
জানেন এবং তোমরা জান না। (আন-নূর ২৪:১৯)
আখিরাতের শাস্তির কথা তো আল্লাহ তাআলা আয়াতে উল্লেখ করেছেন, দুনিয়ার শাস্তির বিষয়ে একটু জেনে নেয়া যাক।
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে
পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর পরিণতি
ক। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা
ও আসক্তি (Neurological Impact)
·
ডোপামিন ডিসরেগুলেশন: পর্নোগ্রাফি দেখার সময় মস্তিষ্কের ডোপামিন (আনন্দদায়ক রাসায়নিক)
অতিরিক্ত নিঃসৃত হয়। এটি মাদকের মতো আসক্তি সৃষ্টি করে (2014-এর গবেষণা, JAMA Psychiatry)।
·
গ্রে ম্যাটার হ্রাস: অতিরিক্ত পর্ন দেখা
মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অংশ) ক্ষতিগ্রস্ত করে
(NeuroImage,
2014)।
ক। মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব (Impact
on Mental Health)
·
অবসাদ ও উদ্বেগ: পর্ন আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডিপ্রেশন, সোশ্যাল অ্যাংজাইটি বেশি দেখা যায় (Journal of
Cyberpsychology, 2016)।
·
পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষতি: সঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া (Journal of Sex
Research, 2015)।
·
বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে 56% ডিভোর্সের কারণ হিসেবে পর্নকে চিহ্নিত করা হয়েছে)।
ক। শারীরিক স্বাস্থ্যের
ঝুঁকি
·
ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (ED): তরুণ পুরুষদের মধ্যে
পর্ন-প্ররোচিত ইমপোটেন্স বাড়ছে (Urology, 2014)। কারণ: মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম অতিরিক্ত উত্তেজনায় অভ্যস্ত
হয়ে পড়ে।
·
প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি: অতিরিক্ত বীর্যপাতের সাথে প্রোস্টেটের স্বাস্থ্যহানি
যুক্ত (Medical Hypotheses, 2016)।
১০।
আল্লাহর জবাবদিহিতার কথা স্মরণ রাখা
প্রতিটি ক্লিক, পোস্ট বা শেয়ারের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই
সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পথে থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَمَن
يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُۥ - وَمَن يَعْمَلْ
مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُۥ
অতএব,কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখতে পাবে। আর কেউ অণু
পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সেও তা দেখতে পাবে। (সূরা আয-যিলযাল ৯৯:৭-৮)
উপসংহার
আজকের ডিজিটাল যুগে
ইন্টারনেট আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আমরা কি এটি ব্যবহার করছি আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে, নাকি নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? পর্দা, সময়ানুবর্তিতা ও
সত্যবাদিতার ইসলামী নীতিগুলো কি আমরা অনলাইন জগতেও মেনে চলি? নাকি অজান্তেই হারাম ও গুনাহের সমুদ্রে ডুব দিচ্ছি? আসুন, ইসলামের আলোকে ইন্টারনেট
ব্যবহারের নৈতিক দিকগুলো খতিয়ে দেখি এবং আমাদের ডিজিটাল জীবনকে ইবাদতে পরিণত করি।
No comments