হজ্জের শিক্ষা ও গভীর তাৎপর্য: একটি পরিপূর্ণ গাইড। জুমুয়ার খুতবা
![]() |
হজ্জের শিক্ষা ও তাৎপর্য |
হজ্জ ইসলামের
পঞ্চম স্তম্ভ এবং একটি মহান ইবাদত, যা আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক
গুরুত্ব বহন করে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়,
বরং জীবনের গভীর শিক্ষার সমষ্টি। হজ্জের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর
সান্নিধ্য লাভ করে, আত্মশুদ্ধি
অর্জন করে এবং গুনাহ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। এতে ধনী-দরিদ্র,
কালো-সাদার সকল বিভেদ মুছে যায়;
সবাই একই পোশাকে একই কাতারে দাঁড়িয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা
দেয়। হজ্জের শিক্ষা হলো ত্যাগ, ধৈর্য,
আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং মানবতার সেবা। এটি মুসলিম
উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতীক, যা সার্বজনীন শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা যোগায়। পবিত্র কুরআনে
বর্ণিত হয়েছে,
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ
اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ
الۡعٰلَمِیۡنَ
এবং সামর্থ্যবান
মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে ব্যক্তি এই নির্দেশ মেনে
চলতে অস্বীকার করে,
তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসী কারো মুখাপেক্ষী
নন। (সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭)
হজ্জ কবুল হওয়ার
শর্তাবলী
যে কোনো
আমল শুধু আদায় করলে হবে না,
বরং তা কবুল হওয়ার শর্ত পূরণ করে আদায় করতে হবে। হজ্জ কবুল
হওয়ার জন্যও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন:
১. ইসলাম: হজ্জকারী মুসলমান হতে হবে। (সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭)
২. সুস্থ বিবেক: আকিদাহ বিশুদ্ধ ও
শিরকমুক্ত হতে হবে। (সূরা আনআম ৬:৬২)১
৩. নিয়ত: একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির
জন্য হজ্জ করতে হবে। (সহীহ বুখারি ১)
৪. হালাল উপার্জন: হজ্জের খরচ হালাল
রুজি থেকে হতে হবে। (সূরা বাকারা ২:১৬৮)
৫. ফরয হজ্জ আদায়: প্রথমে ফরয হজ্জ
সম্পন্ন করতে হবে। (সহীহ মুসলিম ১৩৪৭)
৬. শরীয়তসম্মত পদ্ধতি: হজ্জের সকল
কাজ সুন্নাহ মোতাবেক পালন করতে হবে। (সূরা হজ্জ ২২:৬৭)
৭. সব ধরণের অশ্লীল ও গুনাহের কাজ
থেকে বিরত থাকা। (সূরা বাক্বারা ২:১৯৭)
হজ্জের তাৎপর্য ও ফজিলত
১। তালবিয়া
পাঠঃ হজ্জের কার্যক্রমের শুরু থেকে যদি আমরা এর তাৎপর্য
অনুসন্ধান করি তবে দেখব ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পড়ার মধ্যেই রয়েছে শিরকমুক্ত ঈমান
গ্রহণের প্রশিক্ষণ। নিম্নে হজ্জের প্রধান শ্লোগান তালবিয়া এবং আরেকটি দোয়া উল্লেখ
করছি যা বারবার পাঠ করতে হয় এবং সেখান থেকে একজন হাজী একমাত্র আল্লাহর একত্ববাদ,
সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে অন্য কাউকে কোনো ভাবে
তাঁর সাথে শরীক করার মানসিকতা ত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর হন। যেমন তিনি ইহরাম করার পর
থেকেই বলতে থাকেন:
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا
شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا
شَرِيْكَ لَكَ - قَالَ وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهُمَا يَزِيْدُ فِيْهَا: لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي
يَدَيْكَ لَبَّيْكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ
হে আল্লাহ, তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি হাজির, আমি হাজির। তোমার কোন অংশীদার নেই। সকল প্রশংসা ও নেয়ামতের মালিক
একমাত্র তুমিই। রাজত্ব ও বাদশাহী কেবলমাত্র তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই। আর আব্দুল্লাহ
ইবনে উমর (রাঃ) এর সাথে এ কথাগুলোও বলতেন- "আমি হাজির, সকল প্রকার সুখ ও সৌভাগ্য তোমার নিকটে, কল্যাণ তোমার দু'হাতে,
আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজির আছি। আর আমার সকল বাসনা-কামনা
ও আমল তোমার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। (সহিহ বুখারি ১৫৪৯, সহিহ মুসলিম ১১৮৪)
২। তাকবিরে তাশরিকঃ হজ্জের শেষ দিনে (ইয়াওমুন নহর বা কুরবানির দিন)
জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় পড়ার জন্য প্রসিদ্ধ। এই দোয়াটি হজ্জের শেষ পর্যায়ে আল্লাহর একত্ববাদ, ক্ষমা প্রার্থনা
ও তাঁর সাহায্যের স্বীকৃতি প্রকাশ করে। এটি "তাকবিরে তাশরিক" নামেও পরিচিত, যা ইয়াওমুন
নহর থেকে শুরু করে ১৩ই জিলহজ পর্যন্ত (ঈদের পরের ৩ দিন) প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পড়া
সুন্নত।
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ يَقُولُ فِي أَيَّامِ التَّشْرِيقِ: "لَا إِلَهَ
إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ
وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ
لِرَبِّنَا حَامِدُونَ، صَدَقَ اللَّهُ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ
الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ"
আল্লাহ ছাড়া
কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক,
তাঁর কোনো শরিক নেই। সমস্ত রাজত্ব তাঁরই এবং সমস্ত প্রশংসা তাঁরই।
তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আমরা তাঁর দিকে ফিরছি, তাওবা করছি, ইবাদত করছি,
সিজদা করছি, আমাদের রবের প্রশংসা করছি। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা সত্য করেছেন,
তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত শত্রু দলকে পরাজিত
(বদরের যুদ্ধে) করেছেন । (সহিহ মুসলিম ১২১৮)
সুতরাং
মন-প্রাণ দিয়ে এই দুআ পড়তে হবে। কেউ মুখে বলল লা
শারীকা লাকা। অথচ অন্তরে আছে শিরক- আল্লাহ ছাড়াও অনাদের কাছে গায়েবী সাহায্য চান: তাদের হাজির-নাজিরও মনে করেন। এমন তালবিয়া ও দোয়া পড়ে লাভ
হবে না।
৩। হজ্জ্বের মর্যাদাঃ কুরআন ও হাদিসে হজ্জের হিকমত ও মর্যাদা সম্পর্কে বিশদ ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে।
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ
اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ
الۡعٰلَمِیۡنَ
এবং সামর্থ্যবান
মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে ব্যক্তি এই নির্দেশ মেনে
চলতে অস্বীকার করে,
তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসী কারো মুখাপেক্ষী
নন। (সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭)
৪। আল্লাহর
হক্বঃ হজ্জ বান্দার উপর আল্লাহ তাআলার হক্ব। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না সেসব লোক আল্লাহর হক্ব নষ্ট করে। আর
একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের প্রতিও আয়াত দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে এই যে,
সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ না করা কুফুরী আচরণ। যেমন পবিত্র
কুরআনে সালাত ত্যাগ করাকে মুশরিকী কার্যকলাপ বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
مُنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡهِ وَ اتَّقُوۡهُ وَ اَقِیۡمُوا
الصَّلٰوۃَ وَ لَا تَكُوۡنُوۡا مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ
তাঁর অভিমুখী
হও, আর তাঁকে ভয় কর,
নামায প্রতিষ্ঠা কর, আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
(সূরা রুম ৩০:৩১)
৫। হজ্জ্ব আদায়
করা ফরজঃ হাদিসে আরো এসেছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: خَطَبَنَا رَسُولُ
اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ فَرَضَ اللَّهُ عَلَيْكُمُ
الْحَجَّ فَحُجُّوا»
আবু
হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন। যে মানব মন্ডলী তোমাদের উপর আল্লাহ তা'আলা হজ্জ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্জ আদায় কর। (সহিহ মুসলিম, হজ্জ অধ্যায়
১৩৩৭)
৬। হজ্জ্ব আদায়
না করার পরিণতিঃ হাদিস শরিফে এসেছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "مَنْ مَلَكَ زَادًا
وَرَاحِلَةً تُبَلِّغُهُ إِلَى بَيْتِ اللَّهِ، وَلَمْ يَحُجَّ، فَلَا عَلَيْهِ
أَنْ يَمُوتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا"
রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তির কাছে হজ্জের
অর্থসামগ্রী এবং যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তার
পরও সে হজ্জ করে না তাহলে সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করুক অথবা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যু
যরণ করুক তাতে কিছু যায় আসে না। (সুনান আত-তিরমিযি ৮১২)
৭। কবুল
হজ্জ্বের ফজিলতঃ রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ:
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنْ حَجَّ
لِلّٰهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ»
আবু
হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ্জ্ব করল এবং কোন
অশ্লীল কাজ ও কথাবার্তা এবং কোনো গুনাহের কাজ করল না তাহলে সে নবজাতক শিশু যাকে
তার মা এ মুহূর্তে প্রসব করেছেন, তার মতো
নিষ্পাপ হয়ে ফিরল। (সহীহ বুখারী ১৫২১, সহীহ মুসলিম ১৩৫০)
৮। কবুল
হজ্জ্বর পুরষ্কারঃ
قال رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ
وسلَّمَ:«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالْحَجُّ
الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ»
মাবরূর (গ্রহণযোগ্য)
হজের প্রতিদান জান্নাত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, এক উমরা থেকে আরেক উমরা মাঝখানের গুনাহসমূহ মুছে দেয়। আর মাবরূর (গ্রহণযোগ্য) হজের
প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছু নয়। (সহিহ বুখারি ১৭৭৩, সহিহ মুসলিম ১৩৪৯)
৯। উত্তম আমলঃ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ: سُئِلَ
النَّبِيُّ ﷺ: أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: "إِيمَانٌ بِاللَّهِ
وَرَسُولِهِ". قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: "الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ
اللَّهِ". قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: "حَجٌّ مَبْرُورٌ".
আবু হুরাইরা
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
নবী কারীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো, সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন,
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস।
আবার জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন,
আল্লাহর পথে সংগ্রাম।
জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন,
একটি গ্রহণযোগ্য হজ্ব। (সহীহ আল-বুখারী ১৫১৯)
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهَا قَالَتْ: يَا
رَسُولَ اللَّهِ، نَرَى الْجِهَادَ أَفْضَلَ الْعَمَلِ، أَفَلَا تُجَاهِدُ؟ فَقَالَ: لَا،
وَلَكِنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ حَجٌّ مَبْرُورٌ
উম্মুল মুমিনীন
আয়েশা (রাঃ) বলেছেন: হে রাসূল, আমরা মনে
করি জিহাদই উত্তম কাজ, আপনি কি জিহাদ
করেন না? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন: না, কিন্তু সবচেয়ে
উত্তম জিহাদ হলো গ্রহণযোগ্য হজ্জ। (সুনান আত-তিরমিযি
১০৭৯)
১০। দারিদ্রতা
দূর করেঃ
وَعَنِ ابْنِ
مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
«تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ
وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ
وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلَّا الْجَنَّةَ»
ইবনে মাসউদ
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: হজ্জ ও উমরাকে ধারাবাহিকভাবে
পালন কর, কারণ এ দুটি দারিদ্রতা ও পাপগুলো দূর করে,
যেমন আগুন লোহা,
সোনা ও রূপার ময়লা দূর করে। আর গ্রহণযোগ্য (মাকবুল) হজ্জের
সওয়াব ছাড়া আর কোনো সওয়াব নেই; সেটি হলো জান্নাত। (নাসায়ী ২৬৩১,
তিরমিযী ৮১০)
১১। হজ্জের তাৎপর্যঃ
আমরা
একটু চিন্তা করি কী আছে হজ্জের মধ্যে যার দ্বারা আল্লাহ এত মর্যাদা নির্ধারণ করে
রেখেছেন? হ্যাঁ,
হজ্জের মধ্যে অসংখ্য নিদর্শন ও শিক্ষা আছে,
যা থেকে একজন মুমিন নিজের জীবনকে পরিবর্তন করে আল্লাহর প্রিয়
ব্যক্তি ও সমাজের জন্যে আদর্শ মানুষ হতে পারে। আমরা প্রথমে হজ্জের আয়াতের দিকে
লক্ষ্য করি, দেখব
তাতে কী তাৎপর্য আছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ
الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا
تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ
الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ
হজ্জের মাসসমূহ
নির্দিষ্ট। অতএব,এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্জ আরোপ করে নিল, তার জন্য হচ্ছে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং
ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর।
নিশ্চয় উত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্ন, তোমরা আমাকে
ভয় কর। (সূরা বাকারা ২:১৯৭)
তাহলে আল্লাহ হজ্জের মাধ্যমে মানুষকে অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়াবিবাদমুক্ত করে হাজীদেরকে তাক্বওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করার বিশেষ তাকিদ দিয়ে তাদেরকে বিবেকসম্পন্ন বা আলবাব বলে সম্বোধন করে, একমাত্র তাঁকেই ভয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এসব যদি মানুষেরা অর্জন করে ফেলে তাহলে বুঝতে পারছেন, হজ্জ কত তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে। এর মর্যাদা এত বেশি হবে না কেন? তাই আল্লাহর ভয় ও ভক্তি দ্বারা তাঁর বিধান মানার মানসিকতা অর্জন করেই হচ্ছে যেতে হবে। তবেই বিবেকসম্পন্ন বা আসবাব হওয়া সম্ভব। সূরা আল ইমরান ৭ ও ১৯০-১৯১ নম্বর আয়াতে আলবাব (বিবেক সম্পন্ন) লোকের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে-তারা আল্লাহর আয়াত বা বিধিবিধানকে কোনো রকম কুটিলতার আশ্রয় না নিয়ে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়, আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে তাঁর কুদরতের কাছে মাথা নত করে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। অর্থাৎ প্রতিটি কাজ করার সময় তাঁরই বিধান মতো করে।
তাহলে
নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি
আল্লাহর ব্যবহৃত শব্দ বিবেকসম্পন্ন বা উলুল আলবাব? আমি কি নির্দ্বিধায় আল্লাহর আয়াত মানি, না প্যাচাই? আমি
প্রতিটি কাজে তাঁর হুকুমকে (তাঁর
বিধান মতো হচ্ছে কি না) স্মরণ করি?
তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখে এ থেকে শিক্ষা নিই?
আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি?
চিন্তা করে কি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে,
আল্লাহর অনর্থক কিছুই সৃষ্টি করেননি?
কারণ উক্ত আয়াতদ্বয়ে সেই নির্দেশনা এসেছে।
হজ্জ্বের শিক্ষা
হজ্জের
অন্যতম উদ্দেশ্য আল্লাহর নির্দশনসমূহ দেখে তা থেকে শিক্ষা নেয়া। যেমন আল্লাহ বলেন:
اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ
بِبَكَّۃَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ - فِیۡهِ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ مَّقَامُ اِبۡرٰهِیۡمَ
۬ۚ وَ مَنۡ دَخَلَهٗ كَانَ اٰمِنًا ؕ وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ
مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ
عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ
নিশ্চয়ই
প্রথম ঘর, যা
মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা
মক্কায়। যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য। তাতে রয়েছে স্পষ্ট নির্দশনসমূহ,
মাকামে ইব্রাহীম। আর যে তাতে প্রবেশ করবে,
সে নিরাপদ হয়ে যাবে এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর ঘর-বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরজ। আর যে ব্যক্তি এই
নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে, তার জেনে
রাখা উচিত আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন। (আলে ইমরান ৩:৯৬-৯৭)
اِنَّ الصَّفَا وَ الۡمَرۡوَۃَ مِنۡ شَعَآئِرِ
اللّٰهِ ۚ فَمَنۡ حَجَّ الۡبَیۡتَ اَوِ اعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡهِ اَنۡ یَّطَّوَّفَ
بِهِمَا ؕ وَ مَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا ۙ فَاِنَّ اللّٰهَ شَاكِرٌ عَلِیۡمٌ
নিশ্চয়ই সাফা
ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে বাইতুল্লাহর হজ্জ করবে কিংবা
উমরা করবে তার কোন অপরাধ হবে না যে, সে এগুলোর তাওয়াফ করবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে
কল্যাণ করবে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ উপযুক্ত মূল্যদানকারী সর্বজ্ঞ। (সূরা বাকারা-২:১৫৮)
তাহলে
উক্ত আয়াত দু'টি থেকে বুঝতে পারলাম যে,
আল্লাহর নিদর্শন সমূহ থেকে শিক্ষা নিতে বিশেষভাবে
গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন:
ذٰلِكَ
٭ وَ مَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ اللّٰهِ فَاِنَّهَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ
এটাই হল
আল্লাহর বিধান; যে
আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই। (সূরা হাজ্জ-২২:৩২)
আল্লাহর নিদর্শনসমূহ
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحِلُّوۡا
شَعَآئِرَ اللّٰهِ وَ لَا الشَّهۡرَ الۡحَرَامَ وَ لَا الۡهَدۡیَ وَ لَا
الۡقَلَآئِدَ وَ لَاۤ آٰمِّیۡنَ الۡبَیۡتَ الۡحَرَامَ یَبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا
مِّنۡ رَّبِّهِمۡ وَ رِضۡوَانًا ؕ وَ اِذَا حَلَلۡتُمۡ فَاصۡطَادُوۡا ؕ وَ لَا یَجۡرِمَنَّكُمۡ
شَنَاٰنُ قَوۡمٍ اَنۡ صَدُّوۡكُمۡ عَنِ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اَنۡ تَعۡتَدُوۡا ۘ
وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی
الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ
الۡعِقَابِ
হে
মুমিনগণ, তোমরা
অসম্মান করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহের, হারাম মাসের, হারামে
প্রেরিত কুরবানীর পশুর, গলায়
চিহ্ন দেয়া পশুর এবং আপন রবের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অনুসন্ধানে পবিত্র গৃহের
অভিমুখীদের। যখন তোমরা হালাল হও, তখন
শিকার কর। কোন কওমের শত্রুতা যে, তারা
তোমাদেরকে মসজিদে হারাম থেকে বাধা প্রদান করেছে, তোমাদেরকে যেন কখনো প্ররোচিত না করে যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করবে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম
ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর। (সূরা মায়িদা ৫:২)
এখানে
শা-ইরাল্লাহ বলতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিভিন্ন চিহ্ন (ঘটনা), বিভিন্ন
স্থান, কুরবানী, আমল, সালাত,
সাওম, হজ্ব
ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। উক্ত আয়াতসহ আরো কিছু আয়াত থেকে বোঝা যায় যে,
আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এসব
দেখতে হবে এবং এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আর কেউ পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হলে এসব
দেখে তার বিবেকে নাড়া দেবে। তাঁর মধ্যে চিন্তা আসবে
(১) কেন ও কীভাবে আল্লাহ প্রথমে এই পর বানালেন?
(২) ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর ছেলে মাত্র দুজনে কীভাবে
এত কষ্ট করে এটি নির্মাণ করলেন?
(৩) ইব্রাহীম (আঃ) এর আহসান কীভাবে মানুষের কানে
কানে পৌঁছে দিলেন?
(৪) মানুষের নিরাপত্তার কী সুন্দর ব্যবস্থা আল্লাহ
দিলেন।
(৫) এক পিতা কীভাবে দুধের শিশুকে রেখে চলে যান
জনমানবহীন এলাকায়?
(৬) কীভাবে মা হাজেরা আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে
তাঁর স্বামীকে বলেন "আল্লাহর হুকুমে যদি রেখে থাকেন, তবে যান
আল্লাহই ব্যবস্থা করবেন আমাদের।
(৭) আবার শুধু তাওয়াক্কুল বা ভরসা নয়, বরং
নিজের চেষ্টাও করতে হবে,
তাই তিনি সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করেন।
(৮) আর এর দ্বারা আল্লাহর কী মহিমা প্রকাশিত হলো,এখান থেকে প্রবাহিত হয়ে গেল আবে জমজম। যে ঝর্ণা
আজও বহমান এবং কয়েক লক্ষ হাজীর পানির প্রয়োজন মিটাচ্ছে,
খাদ্যের কাজও হয় তৃষ্ণাও মিটে। লাখ লাখ হাজী সেই পানি পান
করে আবার ২০-৩০ লিটার করে দেশেও নিয়ে আসে। কোনদিন কমও
পড়েনি। আবার হজ্জের পরে যখন হাজী থাকে না, তখন উপচেও পড়ে না।
হজ্জ্ব
এবং এসম্পর্কিত আয়াতগুলোর আলোকে চিন্তা করুন: মহান আল্লাহর হুকুম মানতে গিয়ে
(১) ইব্রাহীম (আঃ) কীভাবে খুশি
মনে তাঁর পিতা ও বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে ছিলেন।
(২) কীভাবে খুশি মনে আগুনে
নিক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন।
(৩) কীভাবে নির্দ্বিধায় নিজের
দুধের শিশু ও স্ত্রীকে জনমানবহীন এলাকায় নির্বাসন দিয়ে এসে ছিলেন।
(৪) শুধু তাই না তিনি আল্লাহর
সন্তুষ্টি লাভের জন্যে কীভাবে নিজের সন্তানকে কুরবানী দিয়ে দিলেন। যদিও আল্লাহ
তাঁর ছেলেকে রক্ষা করেছেন। এবার চিত্র করুন, তিনি কেন এত ভয়ংকর কাজগুলো করতে
গেলেন?
শুধুমাত্র
আল্লাহর হুকুমসমূহকে যথাযথভাবে পালন করার মাধমে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে। তাই
এসব থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা আল্লাহর হুকুমসমূহকে পালন করতে কতটা যত্নবান?
নিম্নের
বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে আমাদের নবী (সাঃ) এর জীবনী থেকেও শিক্ষা নিতে
পারবেন। আপনি হজ্জ করতে গিয়ে দেখবেন, গারে হেরা, গারে সূর,
তায়েফ, বদর,
উহুদ, হুদাইবিয়া,
খন্দক ইত্যাদি বহু ঐতিহাসিক স্থান। সেখান থেকে রাসূল (সাঃ) এর জীবন তার ধ্যান-ধারণা,
কর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে নানা বিষয় ও নানা দিক আপনার মনে
উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আপনি ভাবতে পারবেন কত সীমাহীন কষ্ট ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাসূল
(সাঃ) ও সাহাবীরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
একজন
হাজী সেখানে গিয়ে এসব স্থান দেখে নিজের বিবেকের মধ্যে নাড়া দেবেন। তাঁরা ভাববেন-ইসলাম তথা আল্লাহর দ্বীন এমনি এমনি প্রতিষ্ঠিত
হয়ে যায়নি। এমনি এমনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যাওয়া যায় না। বরং আল্লাহর হুকুম
পদে পদে মানতে হয়। আল্লাহর রঙে রঙিন হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান তথা কুরআন
মোতাবিক নিজের জীবনকে গড়তে হবে। (বাক্বারা ১৩৮ সিবগতাল্লাহ)
আলে ইমরান ১০৩ ওয়া’তসিমু)
আমরা
প্রথম দিকে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসসমূহে পেয়েছি হাচ্ছে মাবরুর। শুধু হজ্জের ফজিলত বলা
হয়নি। হাজ্জে মাবরূরের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হ্যাঁ, এটি হলো হজ্জের মূল বিষয়। যে হজ্জের দ্বারা নিজের জীবনকে পরিবর্তন করা হয়,
তাই হলো হাচ্ছে মাবরূর। তাই নিজের জীবনকে কুরআন-সুন্নাহর রঙ্গে রাঙ্গাতে হবে। পাপসমূহ ছাড়তে
হবে। পূর্বে যেসব উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরোপুরিভাবে ইসলামী বিধান মেনে নেয়ার দীক্ষা নিয়ে হজ্জ
থেকে ফিরতে হবে। আর যাওয়ার সময় এরূপ মানসিকতা নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় শুধু হাজী
নাম লাগিয়ে পাপাচারী মনোভাব রাখার হজ্জ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেন:
وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُ اتَّقِ اللّٰهَ اَخَذَتۡهُ
الۡعِزَّۃُ بِالۡاِثۡمِ فَحَسۡبُهٗ جَهَنَّمُ ؕ وَ لَبِئۡسَ الۡمِهَادُ
যখন তাকে
বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর,
তখন অহঙ্কার তাকে গুনাহর দিকে আকর্ষণ করে, জাহান্নামই
তার জন্য যথেষ্ট আর তা কতই না জঘন্য আবাসস্থল! (সূরা আল বাক্বারা ২:২০৬)
আমাদের
কি এতটুকু চিন্তা করা উচিত নয় যে, কেন
আল্লাহ তাআলা হজ্জের আয়াত সমূহের মাঝখানে এমনি একটি আয়াত উল্লেখ করলেন?
নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে এমনি কিছু স্বভাব আছে,
যা এই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যেনন আমাদের কোনো কোনো হাজীকে
আল্লাহর হুকুমের কথা বললে তারা নারাজ হন। তারা ভাবেন আমি হাজী,
আমাকে আবার সে নসীহত করে। এসব হাজীদের দ্বারা দ্বীনের উপকার
হয় না, বরং ক্ষতি হয়। যেমন কোন এক নাতি এখন নিয়মিত
জামাতের সহিত সালাত আদায় করতে শুরু করেছে। প্রয়োজনে পড়াশুনা বন্ধ রেখেও সালাতে
আসে। তখন তাকে বলা হচ্ছে- তোর দাদা ৫ বার হজ্জ করেছেন।
এখনো নিয়মিত সালাতই আদায় করেন না। আর তুই ক্লাশ নাইনে থাকতেই একেবারে ৫ বেলা
জামাতের সাথে সালাত আদায় করতে শুরু করে দিয়েছিস? তাহলে এসব হাজীদের হজ্জ অন্যদের উপকারে আসে না, বরং ক্ষতির কারণ হচ্ছে। অবশ্য সব হাজী এমন নয়। তাই পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡرِیۡ نَفۡسَهُ ابۡتِغَآءَ
مَرۡضَاتِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ رَءُوۡفٌۢ بِالۡعِبَادِ
আর
মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজকে বিকিয়ে দেয়। আর
আল্লাহ (তাঁর) বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল। (সূরা আল বাকারা ২:২০৭)
প্রকৃত
পক্ষে হজ্জ তারই জন্য যে আখিরাতে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার ও প্রতিদানের
আকাঙ্ক্ষী। যে ব্যক্তি আখিরাতের পুরস্কার ও প্রতিদানের কোন আশা রাখে না এবং
শুধুমাত্র দুনিয়াকে পেতে চায় এমন দুনিয়া পূজারীর হজ্জ আল্লাহর নিকট কোন মূল্যই
রাখে না। নিম্নেবর্ণিত সূরা আল বাক্বারা-২০০ নং
আয়াত হতে দেখা যায়, যারা
দুনিয়া প্রার্থনা করে, তারা
শুধু দুনিয়া পাবে, আখিরাতে
কিছুই পাবে না। তার আগে মহান আল্লাহ বলছেন:
ثُمَّ اَفِیۡضُوۡا مِنۡ حَیۡثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَ
اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
অতঃপর
তোমরা প্রত্যাবর্তন কর, যেখান
থেকে মানুষেরা প্রত্যাবর্তন করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ
ক্ষমাশীল, পরম
দয়ালু। (সূরা বাকারা-২:১৯৯)
فَاِذَا قَضَیۡتُمۡ مَّنَاسِكَكُمۡ فَاذۡكُرُوا
اللّٰهَ كَذِكۡرِكُمۡ اٰبَآءَكُمۡ اَوۡ اَشَدَّ ذِكۡرًا ؕ فَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ
رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا وَ مَا لَهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ خَلَاقٍ
তারপর
যখন তোমরা তোমাদের হজ্জের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে
তোমরা স্মরণ করতে। তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে,
এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ। আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে
বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিন। বস্তুত আখিরাতে তার জন্য কোন অংশ নেই। (সূরা
বাকারা ২:২০০)
وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی
الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ
আর তাদের
মধ্যে এমনও আছে, যারা বলে,
হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের
আযাব থেকে রক্ষা করুন। (সূরা বাক্বারা ২:২০১)
اُولٰٓئِكَ لَهُمۡ نَصِیۡبٌ مِّمَّا كَسَبُوۡا ؕ وَ
اللّٰهُ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ
তারা যা
অর্জন করেছে তার হিস্যা তাদের রয়েছে। আর আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত। (সূরা
বাকারা ২:২০২)
হজের সামাজিক
গুরুত্ব
হজের
অনেক সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। নিম্নে সে সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো।
ক। বৈষম্য দূরীকরণ
হজ্জ
মুসলিম মিল্লাতের সকল বর্ণ, গোত্র ও
প্রাতিগত বৈষম্য দূরীভূত করে। উঁচু-নিচু,
রাজা-এপ্রয়া,
মনিব ঘৃত্য, আরব-অনারব, ধনী-দরিদ্র, সকলেই একই ধরণের পোষাক পরিধান করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভেদা-ভেদের সকল প্রাচীর ভেঙ্গে সাম্যের মন্ত্রে
উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান প্রভুর বিধান পালন করে থাকে। হজ্জ ব্যতীত পৃথিবীর আর অন্য কোন
অনুষ্ঠানে সাম্যের এ দৃষ্টান্ত পরিদৃষ্ট হয় না।
খ। পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি
হজ্জের এ
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান পবিত্র মক্কা
নগরীতে একত্রিত হয়। এ সময় তাদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ,
ভাবের আদান-প্রদান ও
শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। হজ্জের এ অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পিত মানুষ পরস্পরে
আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ কামনা করে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সুখ শান্তি কামনা করে
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা হয়। ফলে তাদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক সৌহার্দ-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। সমগ্র বিশ্বের
মুসলমানগণ হজ্জের প্রতিটি কাজ নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে করে শৃংখলা বোধেরও পরিচয় দেয়।
গ। বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ
সৃষ্টি
হজের সময়
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মিল, জীবন
যাত্রার মিল, অনুভূতির
মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল,
এ প্রত্যেকটি বিষয় মুসলমানদের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ
উন্নয়নে সাহায্য করে। হজ্জের সময় মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা মক্কা শরীফে সমবেত হয়ে
পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভাবের আদান-প্রদান এবং বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে নীতি নির্ধারণ
করতে পারে। আর এসবের নির্দেশনা দিয়ে আরাফার ময়দানে হজ্জের ভাষণ প্রদান করা হয়।
উপসংহার
হজ্জ যেহেতু ইসলামের একটি অন্যতম স্তম্ভ সেহেত্ব প্রতিটি সামর্থ্যবানের উপর হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা। পরবর্তী সময়ে হজ্জের শিক্ষা নিয়ে সারা জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে দিনাতিপাত করা কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ ব্যাপারে কবুল করুন। আমীন।
No comments