শিশুর মানবিক ও শারীরিক বিকাশ |
সুস্থ শিশু বলতে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুকেই বোঝায় না; শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখতে হবে। সাধারণভাবে আমরা শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা মনোযোগ দিই, মানসিক বিকাশে ততটা মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।
শিশুর মানবিক ও শারীরিক বিকাশ
বাড়িতে নতুন শিশু। শিশুটি ফরসা না কালো, চুল বেশি না কম, বাবার মতো না মায়ের মতো—তা নিয়ে মতামত চলছেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুর যথাযথ বিকাশ হচ্ছে কি না। বয়স ও সময় অনুযায়ী সে দেহে-মনে বেড়ে উঠছে কি না। বড় ধরনের কোনো সমস্যা জন্মের সময় হাসপাতালে থাকতেই ধরা পড়ার কথা। কিন্তু খুব ছোট বা মৃদু কোনো সমস্যা নজরের বাইরে থেকে যেতে পারে। তাই মা-বাবা লক্ষ রাখবেন বিকাশের দিকে।
প্রথম বছরে শিশুর বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এই সময়টা, ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য বেড়ে ওঠা এবং বিকাশের ভিত্তি। এই সময়ে শিশুরা অন্য যে কোন সময়ের থেকে তাড়াতাড়ি শেখে। বাচ্চারা এবং ছোট ছেলেমেয়েরা তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এবং তাড়াতাড়ি শেখে যদি তারা ভালবাসা, দেখাশোনা, উত্সাহ এবং মানসিক উদ্দীপনা পায় এবং তার সাথে পুষ্টিকর খাদ্য এবং সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।
১। পারিবারিক
পরিবেশ
শিশুর মানবিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য একটি নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শিশু যেমনিভাবে কথা বলা শিখে তেমনিভাবে শিখে খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণ, সামাজিকতা ইত্যাদি। তাই শিশুর বিকাশে পারিবারিক পরিবেশের গুরুত্ব সব চাইতে বেশি।
২। সুস্থ
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। তাই তার সুন্দর ও নির্ভয় শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব মা–বাবাসহ পরিবারের সব সদস্যের।
৩। পুষ্টিকর
খাবার
শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য শিশুকে অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। জন্মের প্রথম তিন থেকে পাঁচ বছর এই সময়টা শারীরিক বিকাশের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে কোন প্রকার বাঁধাপ্রাপ্ত হলে তা সারিয়ে তোলা অনেকটাই কঠিন।
৪। সৃজনশীল
খেলনা
শিশুর খেলনা হতে হবে আবিষ্কারধর্মী, নাটকীয় ও সৃজনশীল। বয়সভেদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উপযোগী খেলনা নির্বাচন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ঘরে ও বাইরে দুই জায়গায়ই খেলা যায়—এমন খেলনা শিশুর মানসিক বিকাশে বেশি সহায়ক। শিশুকে এমন ধরনের খেলনা দিতে হবে, যা তার বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে।
৫। ছবি
আঁকা
দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে শিশুরা যদি ছবি আঁকার সুযোগ পায়, তাহলে তারা মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভিনব চিন্তার মাধ্যমে শিশু যখন বিভিন্নভাবে শিল্পচর্চার সুযোগ পায়, তখন তার সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। সে অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে, যা তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শেখায় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে সে তখন সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
৬। বই
পড়া
বই শিশু মনের সুপ্ত ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। একসময় মা-খালা-দাদির মুখ থেকে ঠাকুমার ঝুলির গল্প শুনে সময় কাটত শিশুদের। এখন এর ব্যতিক্রম ঘটছে। আগেকার সেসব গল্প এখন শিশুরা শুনতে পারে না। শিশু বয়স থেকেই তাই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গল্পের বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হয় এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে শিশুরা জটিল শব্দ ও বাক্য সহজে বুঝতে পারে। এতে তার পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় শিশুর বুদ্ধিমত্তা। শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার পাশাপাশি শিশুর মানসিক বিকাশের দিকেও নজর রাখুন। অভিভাবক হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনাকেই।
শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে?
ঠিক বয়সে
ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, বসতে না পারা, হাঁটতে
না পারা, কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা
করা, মুখ দিয়ে সব সময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী
নিজের যত্ন নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, আগ্রাসী-হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল
হওয়া, সমবয়সী কারও সঙ্গে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা,
নিজের শরীরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেঁড়া,
হাত কামড়ানো, দেয়ালে মাথা ঠোকা, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক
আচরণ করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে শিশুর বিকাশের সমস্যা হচ্ছে। শিশুর বিকাশের
সমস্যার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে
হবে। কারণ, যত দ্রুত শিশুকে পরিচর্যায় আনা যায় ততই মঙ্গল।