আদর্শ স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) What was the Prophet (peace be upon him) like as an ideal husband

 

আদর্শ স্বামী হিসেবে বিশ্বনবী (সাঃ)

একজন স্বামী স্ত্রীর কতটা একান্ত কাছের? কতটা সহানুভূতিশীল? কত বড় প্রেমিক হতে পারে বিশ্বনবী তার দাম্পত্য জীবনে দেখীয়ে গেছেন।

বিশেষ করে বর্তমানে দাম্পত্য কলহ দুর করতে রাসুলের এই সকল সুন্নাহর চর্চার বিকল্প নেই। আমাদের ইসলাম শ্রেষ্ঠ কেন? কারণ ইসলামই একমাত্র জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম। জীবনে প্রতিটি দিকেই ইসলাম নিক-নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। খাওয়া-শোয়া। বাজার-সরকার। পড়া-লেখা। জিহাদ-কিতাল। ঘরসংসার-দেনদরবার। ওজুগোসল। বাসরঘর-রান্নাঘর। ড্রয়িংরূম-বাথরূম সব জায়গার আদর্শ আমাদের নবীজি রেখে গেছেন।

আজ আমরা দেখবো তিনি স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন। আমাদের কল্পনায় একজন স্বামীর যা যা গুণ থাকতে পারে, তার মধ্যে এর চেয়েও হাজারগুণ বেশি গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। নবীজ সা. স্ত্রীদের কাছে সবচেয়ে বড় সান্তনার জায়গা ছিলেন। তাদের অশ্রু মুছে দেয়ার মাধ্যম ছিলেন। তিনি স্ত্রীদের কোনও কথাকেই হেসে উড়িয়ে দিতেন না। তাদের আবেগ-অনুযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাদের মনোভার লাঘব করার চেষ্টা করতেন।

বর্তমানে বাজারে, সুখি দাম্পত্যজীবন বা সফল কাপল বা কিভাবে ভালো স্বামী/স্ত্রী হবেন, মেসালি বিবি-শাওহার-এ ধরনের  অনেক চটকদার বই পাওয়া যায়। কিছু বই বেস্টসেলারও হয়। কিন্তু কোনও বইই নবীজির মতো স্বামীর পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে পারবে না। নবীজির দাম্পত্যের অন্দরে একটু ঢুঁ মেরে দেখা যাক:

(এক) পাত্রের একই স্থানে মুখ লাগিয়ে পানাহার করতেন নবীজি:

আমি (আয়েশা) পান করে পাত্রটা নবীজির দিকে বাড়িয়ে দিতাম। তিনি আমার এঁটো করা স্থানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। দাঁত দিয়ে গোশত ছিঁড়ে খাওয়ার পর আমার লালা লেগে থাকা স্থানেই তিনি মুখ লাগিয়ে খেতেন (মুসলিম)।

(দুই) স্ত্রীর গায়ে হেলান দিয়ে বসা:

তিনি আমি হায়েয অবস্থায় থাকলেও, আমার কোলে হেলান দিয়ে বসতেন (আয়েশা রা.-মুসলিম)।

(তিন) চুল আঁচড়ে দেয়া। নখ কেটে দেয়া:

তিনি মসজিদে থাকলেও, জানলা দিয়ে মাথাটা আমার হুজরার দিকে বাড়িয়ে দিতেন, আমি তার চুল আঁচড়ে দিতাম (আয়েশা রা.-মুসলিম)।

(চার) নবীজি সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন।

ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীদেরকে সময় দিতেন। তবে রাতের বেলায়, চারদিক নিরব হয়ে এলে, তিনি আয়েশা রা.-এর সাথে ঘুরতে বের হতেন। হাঁটতে হাঁটতে কথাবার্তা বলতেন (বুখারী)।

.

(পাঁচ) স্ত্রীদের সাথে নবীজি হাসি-মজা করতে ভালোবাসতেন।

তিনি নিজেই শুধু গল্প বলতেন তা নয়, স্ত্রীদের কাছ থেকেও গল্প শুনতেন। একবার আয়েশা রা. তাকে শুধালেন:

ইয়া রাসূলাল্লাহ! ধরা যাক আপনি উট নিয়ে কোনও এক চারণভূমিতে গেলেন। সেখানে একটা গাছ আছে, যার পাতা আগেই খেয়ে ফেলা হয়েছে। আরেকটা গাছ আছে, যেটার পাতা এখনো অক্ষত! আপনি কোন গাছের কাছে উটকে নিয়ে যাবেন?

-যে গাছে এখনো কোনও কিছু মুখ দেয়নি সেটার কাছে নিয়ে যাবো!

আয়েশা বোঝাতে চেয়েছিলেন, নবীজির স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বিয়ের সময় কুমারী ছিলেন। বাকীদের সবাই আগে অন্য স্বামীর ঘর করেছেন। (বুখারী)।

ছয়: নবীজি গৃহস্থালি টুকিটাকি কাজেও হাত লাগাতেন। এটাসেটা করতেন। পুরোদস্তুর সাংসারিক। গৃহী।

-নবীজি ঘরে থাকলে কী করতেন?

-তিনি পরিবারের কাজে অংশ নিতেন! (বুখারী)।

(সাত) শুধু স্ত্রীদের ভালোবাসতেন না কিন্তু নয়, তাদের বান্ধবীদেরকেও ভালোবাসতেন।

খোঁজখবর রাখতেন। যোগাযোগ ছিন্ন হতে দিতেন না। এটা সেটা হাদিয়া পাঠাতেন। ছাগল যবেহ হলেই কিছু গোশত আলাদা করে বলতেন:

-এটা খাদীজার (অমুক) বান্ধবীর বাড়িয়ে দিয়ে এসো! (মুসলিম)।

(আট) মানুষ প্রশংসা ভালোবাসে। স্বীকৃতি চায়। স্ত্রীও স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে চায়। গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠতে চায়। নবীজিও স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন:

সারীদ যেমন সমস্ত খাবারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, আশেয়াও তেমনি অন্য নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ (মুসলিম)।

সারীদ হলো রুটির টুকরোকে ঝোলে ভিজিয়ে তৈরী করা একপ্রকার খাবার!

(নয়) আশেয়া রা.-এর কাছে তার ছেলেবেলার বান্ধবীরা আসতো।

তার বয়েস তখনো কমই ছিল। পুতুল খেলতে পছন্দ করতেন। সইদের সাথে তিনি খেলতেন। নবীজি ঘরে এলে, খেলতে আসা সহেলীরা পালিয়ে যেতো। নবীজি  তাদেরকে অভয় দিয়ে আয়েশার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। খেলার সুযোগ করে দিতেন (মুসলিম)।

(দশ) ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার বস্তু নয়। যদি সেটা হালাল হয়। নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাও অন্যদের কাছে প্রকাশ করা যায়। খোদ নবীজি বলেছেন:

আমাকে খাদীজার ভালোবাসা দান করা হয়েছে। (তার প্রতি আমার ভালোবাসাটা আল্লাহর তরফিয়া)। মুসলিম।

(এগার) স্ত্রীর শুধু দোষ নয়, তার গুণগুলোও খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো প্রকাশ করা দরকার। অপছন্দনীয় কিছু দেখলে অমনিই তেতে ওঠার কোনও কারণ নেই:

স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি যেন অন্যায় আচরণ না করে। তার কোনও একটা স্বভাব পছন্দ না হলেও, আন্য আরেকটা স্বভাব পছন্দ হবে! (মুসলিম)।

(বারো) নবীজি বেগানা কোনও নারীর প্রতি দৃষ্টি দিতেন না। কিন্তু রাস্তায় হাঁটলে অজান্তেই চোখ পড়ে গেলে, ঘরে চলে আসতেন:

তোমাদের যদি বেগানা কোনও নারীর দিকে তাকিয়ে ফেলে, মনে ভিন্নচিন্তা জাগ্রত হলে, সে সাথে সাথে স্ত্রীর কাছে চলে যাবে। নিজের প্রয়োজন পুরো করবে (মুসলিম)।

(তেরো) একান্ত ঘরোয়া ব্যাপারগুলো বাইরের কারো কাছে না ভাঙা। দুজনের গোপন বিষয় দুজনের কাছেই থাকতে দেয়া:

কেয়ামতের দিন নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হবে যে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়, অতঃপর সেটা অন্যদের কাছে ফাঁস করে দেয় (মুসলিম)।

(চৌদ্দ) নবীজি স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসাকে নানাভাবে প্রকাশ করতেন। তাদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার সামান্যতম সুযোগও হাতছাড়া করতে চাইতেন না। তিনি রোযা থাকাবস্থায় চুমু দিয়ে ভালোবাসার জানান দিতেন (মুসলিম)।

(পনের) নবীজি পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সব সময়। স্ত্রীদের কাছে আসার আগে নিজেকে সুন্দর-সুগন্ধিময় করে নিতেন। আয়েশা রা. বলেছেন:

আমি তার চুলের সিঁথিতেও মিশকের সাদা অবশিষ্টাংশ দেখেছি। তখন তিনি ইহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন (মুসলিম)।

(ষোল) নবীজি সা. পালাক্রমে সব বিবির সাথে থাকতেন। আয়েশার প্রতি তার আলাদা একটা টান ছিল। নবীজি সব বিবির প্রতিই ইনসাফ কায়েম করার চেষ্টা করতেন। সাহাবায়ে কেরাম খোঁজ রাখতেন, নবীজি আয়েশার ঘরে কোনদিন যাবেন। সেদিন তারা বেশি বেশি হাদিয়া পাঠাতেন। নবীজির সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে (মুসলিম)।

.

(সতের) স্ত্রীর আবেগ-অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখা। তার মনকে বুঝতে পারা স্বামীর কর্তব্য। নবীজিও বিবিদের কার মেজায কেমন, বুঝতে পারতেন। সেটার প্রতি সম্মান দেখাতেন:

আয়েশা! আমি বুঝতে পারি, তুমি কখন আমার প্রতি রাজি থাকো আর কখন আমার প্রতি নারায থাকো! তুমি আমার প্রতি খুশি থাকলে বলো:

-মুহাম্মদের রবের কসম!

আর আমার প্রতি অখুশি থাকলে বলো:

-ইবরাহীমের রবের কসম! (মুসলিম)।

(আঠার) উমার রা. বলেছেন:

আমার স্ত্রী একবার আমার এক সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করলো। আমাকে সিদ্ধান্তটা পুনর্বিবেচনা করতে বললো। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। স্ত্রী বললো:

- বা রে! নবীজির স্ত্রীরা পর্যন্ত নবীজির কাছে কোনও কোনও সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানাতেন! আর আপনি আমার ক্ষেত্রে অস্বীকার করছেন? উম্মুল মুমিনীনদের কেউ কেউ তো নবীর সাথে রাগ করে একদিন একরাত পর্যন্ত কথা বলেন নি, এমনো হয়েছে! (বুখারী)।

আহা নবীজিও! কী অসাধারণ সহনশীল মানুষ ছিলেন তিনি!

(উনিশ) আয়েশা রা. বলেছেন:

রাসূলুল্লাহ সা. কখনোই কোনও স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেননি (নাসায়ী শরীফ)।

আর এখন এসিড পর্যন্ত ছুঁড়ে মারে। কথায় কথায় ডিভোর্স!

(বিশ) সাফিয়া রা. এক সফরে নবীজির সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। সাফিয়া কিছুটা ধীরে পথ চলছিলেন। পিছিয়ে পড়েছিলেন। নবীজি তার কাছে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সাফিয়া কাঁদছেন আর বলছেন:

-আপনি আমাকে একটা ধীরগামী গাধায় সওয়ার করিয়েছেন!

নবীজি স্নেহভরে সাফিয়ার চোখের অশ্রু মুছে দিলেন। তাকে না কেঁদে চুপ করতে বললেন (নাসায়ী)।

তিনি কতোই প্রেমময় ছিলেন। আমি হলে কী করতাম! দ্রুত চলতে না পারলে কেন এসেছ!

(একুশ) নবীজি আরও অবিশ্বাস্য (আমাদের যুগের দৃষ্টিভঙ্গিতে) কাজও করেছেন। তিনি বলেছেন:

তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমা তুলে দিবে, সেটার বিনিময়েও আল্লাহ তোমাকে সওয়াব দান করবেন (বুখারী)।

আহা এভাবে ভালোবাসতে জানলে, জীবনে আর কিছুর অভাব থাকে?

(বাইশ) স্ত্রীর চাহিদার প্রতিও নবীজির ছিল তীক্ষ্ণ নজর। তিনি বলেছেন:

= তুমি যখন খাবার খাবে, স্ত্রীকেও খাওয়াবে। তুমি যখন পরিধান করবে, স্ত্রীকেও পরিধান করবে (হাকেম)।

অর্থাৎ তিনি স্ত্রীকে সমমর্যাদা দিয়ে রাখতে বলেছেন। দাসী-বাঁদী করে নয়।

(তেইশ) স্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখা। তাকে সন্দেহ না করা। নবীজি বলেছেন: কোনও পুরুষ যেন রাতের বেলা না বলে, আচানক ঘরে এসে উপস্থিত না হয়, স্ত্রীর দোষ ধরার উদ্দেশ্যে (মুসলিম)।

(চব্বিশ) স্ত্রীর আবেগ অনুভূতির প্রতিও লক্ষ্য রাখা। নবীজি মিথ্যাকে একদম প্রশয় দেননি। কোনও প্রকার ছাড়া দেননি। কিন্তু তিনটা ক্ষেত্রে মিথ্যার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন। তার মধ্যে একটা হলো:

পুরুষ স্ত্রীকে খুশী করার জন্যে মিথ্যা বললে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে খুশী করার জন্যে মিথ্যা বললে! (নাসায়ী)।

(পঁচিশ) যার দুইজন স্ত্রী আছে, একজনের প্রতি বাহ্যিক আচরণে যদি বেশি ঝুঁকে পড়ে, তাহলে কেয়ামতের দিন সে একপাশ ঝুঁকে থাকা অবস্থায় কবর থেকে উঠবে! (তিরমিযী)।

স্ত্রীর প্রতি ইনসাফ করা আবশ্যক।

(ছাব্বিশ) কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকলেও স্ত্রীর খোঁজ-খবর রাখা। শুধু কাজ নিয়েই মজে না থাকা। সারাদিনে একবারও স্ত্রীর খোঁজ না নিয়ে, সুন্নাতের খেলাফ হওয়ার আশংকা আছে। আনাস রা. বলেছেন:

নবীজি রাতে বা দিনে, একবার হলেও স্ত্রীদের খোঁজ-খবর করতেন (বুখারী)

(সাতাশ) মায়মুনা রা. বলেছেন:

নবীজি স্ত্রীরা হায়েয অবস্থায় থাকলেও, তাদেরকে আদর করতেন। পায়জামার উপর দিয়ে। নাপাক মনে করে, তাদেকে একেবারে ছেড়ে যেতেন না (বুখারী)।

এখানে শুধু আদরই করতেন। সহবাস নয়।

(আঠাশ) আয়েশা রা. বলেছেন:

একদিন আমি আর তিনি বসে আছি। এমন সময় যয়নব এলো। রাগান্বিতা অবস্থায়। নবীজি আমাকে বললেন:

-নাও তার সাথে বিতর্ক করো!

আমি এমত তর্ক করলাম, কিছুক্ষণ পর দেখলাম যয়নবের মুখের লালা শুকিয়ে গেছে। সে আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রাসুলুল্লাহর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি হাসছেন! ব্যাপারটা উপভোগ করছেন (ইবনে মাজা)।

(উনত্রিশ) নবীজি সফরে যাওয়ার সময়, স্ত্রীদের নামে লটারী করতেন। কাকে সাথে নিয়ে যাবেন। লটারীতে যার নাম উঠতো, তাকে সাথে নিয়ে যেতেন (মুত্তাফাক)।

আজ এই সুন্নাত বড়ই অবহেলিত। সবার এদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। একটা মরা সুন্নাতকে জীবিত করার সওয়াব কি কম?

(ত্রিশ) স্ত্রীদের সাথে খেলাধূলা করা। আয়েশা রা. বলেছেন:

-একবার নবীজি আমাকে বললেন: চলো দৌড় প্রতিযোগিতা করি! আমরা দৌড়ালাম। আমি তার চেয়ে এগিয়ে থেকে দৌড় শেষ করলাম। কিছুদিন পর আমি স্বাস্থ্য একটু ভাল হলে, তিনি আবার একদিন প্রতিযোগিতা দিতে বললেন। এবার তিনি জয়ী হলেন। মুচকি হেসে বললেন:

-এটা সেটার বদলা। শোধবোধ। (আবু দাউদ)।

(একত্রিশ) স্ত্রীকে আদর করে অন্য নামে সম্বোধন করাও সুন্নত। আয়েশা রা. বলেছেন:

= ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ছাড়া আপনার আর সব স্ত্রীদের একটা করে কুনিয়ত(উপনাম) আছে। তখন নবীজি আমার কুনিয়ত দিলেন: উম্মে আবদুল্লাহ। (আহমাদ)।

(বত্রিশ) স্ত্রীকে গল্প শোনানোও সুন্নাত। নবীজি সুযোগ পেলেই, স্ত্রীদেরকে গল্প শোনাতেন। খুনসুটি করতেন। চমৎকার একটা গল্প বুখারী শরীফে আছে। উম্মে যরা-এর গল্পটাতো বিখ্যাত।

(তেত্রিশ) ঈদে-উৎসবে স্ত্রীদেরও শরীক করা। তাদেরকে সাথে নিয়ে উপভোগ করা সুন্নাত। আয়েশা রা. বলেছেন:

একবার মসজিদের চত্ত্বরে কিছু হাবশী বালক বর্শা নিয়ে খেলাধূলা করছিল। নবীজি তাদের খেলা দেখছিলেন। আমিও তার পেছনে দাঁড়িয়ে, তার গায়ে হেলান দিয়ে খেলাটা উপভোগ করেছি (বুখারী)।

(চৌত্রিশ) কেউ কষ্ট পায় এমন শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করতেন না। স্ত্রীদের সাথে এবং খাদেমদের সাথেও। আনাস রা. বলেছেন:

আমি দশ বছর নবীজির খেদমত করেছি। একদিনের তরেও তিনি কোনও কাজের জন্যে আমাকে পাকড়াও করে বলেননি: কেন এমনটা করেছো?

(পঁয়ত্রিশ) স্ত্রীদের এবং অন্যদের শখের প্রতি তিনি সম্মান দেখাতেন। অন্যকে খাটো করে দেখতেন না। আয়েশা রা. বলেছেন:

আমি বান্ধবীদের সাথে পুতুল খেলতাম। তিনি ঘরে এলে, বান্ধবীরা ভয় পেয়ে যেতো। তারা লুকিয়ে পড়তো। কিন্তু নবীজি নিজেই সরে গিয়ে, তাদেরকে খেলার সুযোগ করে দিতেন। নিষেধ করতেন না (আদাবুল মুফরাদ)।

(ছত্রিশ) ঘরোয়া পরিবেশকে হাসি-আনন্দপূর্ণ রাখা। নির্দোষ দুষ্টুমি করাও সুন্নাত। আয়েশা রা. বলেছেন:

একবার সাওদা আমার ঘরে বেড়াতে এলেন। নবীজি একপা আমার কোলে, আরেক পা সাওদার কোলে তুলে দিলেন। আমি সাওদার জন্যে হারীরা (এক প্রকার খাবার) তৈরী করলাম। তাকে বললাম:

-খাও!

-আমি খাবো না!

-খাও বলছি, নইলে খাবারটা আমি তোমার মুখে মেখে দিবো!

-না আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না!

আমি একমুঠ হারীরা উঠিয়ে সাওদার মুখে মেখে দিলাম। এটা দেখে নবীজি মিটিমিটি হাসছিলেন (নাসায়ী)।

(সায়ত্রিশ) একজনকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে না পড়া। পালা থাকলেও, সবার প্রতি দৃষ্টি রাখা। আয়েশা রা. বলেছেন:

খুব দিনই এমন গিয়েছে, নবীজি আমাদের সবার কাছে আসেননি। তিনি প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। হাত ধরতেন। সবাইকে অন্তত চুমু হলেও খেতেন। সবার শেষে যেতেন, আজ যার কাছে থাকার পালা, তার ঘরে (তাবাকাতে সাদ)।

(আটত্রিশ) স্ত্রীদের সাথে সাময়িক মনোমালিন্য হলেও নবীজি কাউকে খাটো করতেন না। কথাবার্তায় কোমল পন্থা অবলম্বন করতেন। আয়েশা রা. বলেছেন:

ইফকের ঘটনায়, তিনি আমার প্রতি আগের মতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন না। আমি অভিযোগ করলে, তিনি কোমল আচরণ করতেন। কিন্তু আমার কষ্ট লাগতো, আমি সে ঘটনার ভার সইতে না পেরে, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তিনি এসে আমার আম্মার কাছে জানতে চাইতেন:

সে কেমন আছে?

নাম নিতেন না (বুখারী)।

(উনচল্লিশ) স্ত্রীরা অসুস্থ হলে, নবীজি তাদের সেবা-সুশ্রুষা করতেন। আয়েশা রা. বলেছেন:

আহলে বাইতের কেউ অসুস্থ হলে, তিনি আউযু সম্বলিত আয়াতসমূহ পড়ে ফুক দিতেন (মুসলিম)।

(চল্লিশ)  নবীজি সা. অন্যদেরকে ভাল স্বামী হতে নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করতেন। নিজে একজন ভাল স্বামী হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো ছিলেনই, তারপরও মৌখিকভাবেও বলতেন:

তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলো, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম বলে বিবেচিত সেই! (তিরমিযী)।

(একচল্লিশ) নবীজি সফর থেকে এসে, চট করে ঘরে চলে যেতেন না। স্ত্রীদেরকে সাজগোজ করার সুযোগ দিতেন। প্রস্তুতি নেয়ার সময় দিতেন। জাবের রা. বলেছেন:

আমরা একবার সফর থেকে মদীনায় ফিরলাম। ঘরে যেতে উদ্যত হলে, নবীজি বললেন:

থামো, স্ত্রীদেরকে সুযোগ দাও। রাতের দিকে ঘরে যেয়ো। স্ত্রীরা এর মধ্যে ক্ষৌরকর্ম সেরে নিতে পারবে। আলুলায়িত কেশ বিন্যাস করে নিতে পারবে! (নাসায়ী)।

নবীজি সা.-এর চেয়ে ভাল স্বামী হওয়া কারো পক্ষে সম্ভব? অন্তত চেষ্টা করতে দোষ কী? তার মতো আমদেরও সব স্ত্রীর প্রতি সমান নজর রাখা অবশ্য কর্তব্য। তাদের অধিকার আদায় করার অপরিহার্য।