দারসুল কুরআন
সূরা বাকারা ১-৫
দারসুল কুরআন সূরা বাকারা, আয়াত ১-৫ |
الٓـمّٓ ۚ
ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚ فِیۡہِ ۚ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ
الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَیُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَمِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ
وَالَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَمَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَبِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ
اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ ٭ وَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
সরল অনুবাদ
আলিফ লাম মীম। (১)
এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ
প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য, (২)
যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং
নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে। (৩)
এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের
উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার
পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে।
(৪)
তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম। (৫)
নামকরণ
বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭৩ নম্বর
আয়াত পর্যন্ত হযরত মুসা এর সময়কার বনি ইসরাইল এর গাভী কুরবানীর ঘটনা উল্লেখ
থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের প্রত্যেকটি সূরার এত ব্যাপক
বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ
ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবি
ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও মূলত এটি তো মানুষেরই ভাষা আর মানুষের মধ্যে প্রচলিত
ভাষাগুলো খুব বেশি সংকীর্ণ ও সীমিত পরিসর সম্পন্ন। সেখানে এই ধরনের ব্যাপক
বিষয়বস্তুর জন্য পরিপূর্ণ অর্থব্যাঞ্জক শিরোনাম তৈরি করার মতো শব্দ বা বাক্যের
যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর
নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত
ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এটি এমন সুরা যেখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।
শানে নুযুল
এ সূরার বেশীর ভাগ আয়াত মহানবী-এর মদীনায়
হিজরতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয়। আর এর কিছু অংশ পরে নাযিল
হয়।
আলোচ্য বিষয়
সুরা বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াত এর আলোচ্য
বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রথমেই পবিত্র কোরআনের নির্ভুলতার চ্যালেঞ্জ
করা হয়েছে। এ কয়টি আয়াত এর আলোচ্য বিষয় মূলত মুত্তাকীদের পরিচয় সম্পর্কে।
ব্যাখ্যা
এই সূরার শুরুতে আলিফ-লাম-মীম অক্ষর গুলো
সম্পর্কে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশের মত হল অক্ষর গুলো অর্থ সম্পর্কে
আল্লাহ ভাল জানেন তিনি সেগুলো জানাননি।
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন
এই কিতাব এমন একটি কিতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআনের নানা
জায়গায় আল্লাহ এই কোরআনের নির্ভুলতার চ্যালেঞ্জ করেছেন। আর তখনই এ কিতাব নির্ভুল
গ্রন্থ হিসেবে ধরে নেয়া হবে যখন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে এটি একমাত্র
সৃষ্টিকর্তা তথা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কিতাব। কারণ একমাত্র সৃষ্টিকর্তার পক্ষ
থেকে প্রেরিত কিতাব ব্যতীত নির্ভুল কোন গ্রন্থ হওয়া সম্ভব নয়। এ কুরান নিয়ে যদি
কারো সন্দেহ থাকে তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা তিনটি উল্লেখযোগ্য
চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।
১) কুরআনের মত আরেকটি গ্রন্থ রচনার চ্যালেঞ্জ
قُلۡ لَّئِنِ اجۡتَمَعَتِ الۡاِنۡسُ وَالۡجِنُّ عَلٰۤی اَنۡ یَّاۡتُوۡا بِمِثۡلِ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنِ لَا یَاۡتُوۡنَ بِمِثۡلِہٖ وَلَوۡ کَانَ بَعۡضُہُمۡ لِبَعۡضٍ ظَہِیۡرًا
বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ
রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবং তারা
পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও
এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না। (সুরা বানী ইসরাইল ১৭:৮৮)
২) দশটি সুরা রচনার চ্যালেঞ্জ
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىہُ ؕ قُلۡ فَاۡتُوۡا بِعَشۡرِ سُوَرٍ مِّثۡلِہٖ مُفۡتَرَیٰتٍ وَّادۡعُوۡا مَنِ اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
তারা কি বলে? কোরআন তুমি তৈরী করেছ? তুমি বল, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরী করে নিয়ে আস এবং আল্লাহ
ছাড়া যাকে পার ডেকে নাও, যদি তোমাদের
কথা সত্য হয়ে থাকে। (সুরা হুদ ১১:১৩)
৩) একটা সুরা রচনার চ্যালেঞ্জ
وَاِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা
আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে
সঙ্গে নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা
সত্যবাদী হয়ে থাকো। (সুরা বাক্বারা ২:২৩)
এরপর আল্লাহ বলেন এই কোরআন খোদাভীরুদের জন্যে
পথপ্রদর্শক। এখন প্রশ্ন হলো খোদাভীরু কারা? আল্লাহ বলেন
الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَیُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَمِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ
وَالَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَمَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَبِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ
১) যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে
অদৃশ্য বিশ্বাস তথা আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস
করা এবং এমন কিছু বিষয়ের উপরে বিশ্বাস করা যেগুলো আমাদের জ্ঞানসীমা এবং কল্পনা
সীমার বাহিরে। যেমন আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, কবরের আজাব ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলামী আকীদার অংশ হলেও
সেগুলো না দেখে কোন প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করাই হচ্ছে আখিরাতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ
সুবহানাতায়ালা সুরা মুমিনুন (৪০) এর ৩৯ নম্বর আয়াতে বলেন
یٰقَوۡمِ اِنَّمَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا مَتَاعٌ ۫ وَّاِنَّ الۡاٰخِرَۃَ ہِیَ دَارُ الۡقَرَارِ
হে আমার কওম, পার্থিব এ জীবন তো কেবল উপভোগের বস্তু, আর পরকাল হচ্ছে স্থায়ী বসবাসের গৃহ।
২) সালাত প্রতিষ্ঠা করে
মুত্তাকির আরো একটি অন্যতম করেছে হলো তারা
সালাত প্রতিষ্ঠা জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা যত
জায়গায় সালাতের কথা বলেছেন সব জায়গায় সালাত আদায় করার কথা বলেননি। বরং বলেছেন
সালাত প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'য়ালা সূরা হুদ (১১) এর
১১৪ নম্বর আয়াতে বলেন
وَاَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّہَارِ وَزُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ ؕ اِنَّ الۡحَسَنٰتِ یُذۡہِبۡنَ السَّیِّاٰتِ ؕ ذٰلِکَ ذِکۡرٰی لِلذّٰکِرِیۡنَ ۚ
আর দিনের দুই প্রান্তেই নামায ঠিক রাখবে, এবং রাতের প্রান্তভাগে পূর্ণ কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়, যারা স্মরণ রাখে তাদের জন্য এটি এক মহা স্মারক।
عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ بَايَعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى إِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ.
জারীর ইব্নু ‘আবদুল্লাহ্ আল-বাজালী (রাঃ)
থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেনঃ আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট
বায়‘আত গ্রহণ করেছি সালাত কায়িম করার, যাকাত প্রদান করার এবং সমস্ত মুসলিমের মঙ্গল কামনা করার। (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৫৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৫৫)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৭
৩) প্রাপ্ত রিযিক থেকে ব্যয় করে
মুত্তাকির আরো একটি অন্যতম পরিচয় হচ্ছে
বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত রিযিক থেকে সে আল্লাহর পথে ব্যয়
করবে। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ২৫৪ নম্বর আয়াতে বলেনঃ
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ یَوۡمٌ لَّا بَیۡعٌ فِیۡہِ وَلَا خُلَّۃٌ وَّلَا شَفَاعَۃٌ ؕ وَالۡکٰفِرُوۡنَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম।
৪) আল্লাহ প্রদত্ত সকল আসমানী কিতাবের প্রতি
বিশ্বাস স্থাপন করে
কুরআনের প্রতি বিশ্বাস করার পাশাপাশি একজন
মুত্তাকী ব্যক্তির উপর আবশ্যক হলো সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রাখা। কুরআন
ব্যতীত বাকি ১০৩ খানা আসমানি কিতাব। গুগোল আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এবং সেগুলোর
প্রতি মনের মধ্যে সম্মান লালন করতে হবে। যদিও কোরআনের বর্তমানে সে কিতাব গুলোর
হুকুম বাস্তবায়িত হবে না। আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ৪৮ আয়াতে বলেন।
وَاَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَمُہَیۡمِنًا عَلَیۡہِ
আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববতী গ্রন্থ সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর
বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।
৫) আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে
এ দুনিয়ার জীবনে আমাদের শেষ নয়। এরপরে আরো
একটি জীবন আসবে সে জীবনে আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনের কর্ম অনুযায়ী ফলাফল ভোগ করতে
হবে। এ বিশ্বাস মন লালন করে দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করতে হবে এবং আখিরাতের জীবনের
প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা সুরা দোহা (৯৩) এর ৪ নম্বর
আয়াতে বলেন
وَلَلۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لَّکَ مِنَ الۡاُوۡلٰی ؕ
আপনার জন্যে পরকাল ইহকাল অপেক্ষা শ্রেয়।
উপরোক্ত আলোচনায় মুত্তাকির পরিচয় উল্লেখ করা
হয়েছে। ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা মুত্তাকীর পুরস্কার হিসেবে বলেন
তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত এবং তারাই সফলকাম।
শিক্ষা
আলোচ্য আয়াতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের
দুনিয়ার জীবনের শান্তি এবং আখেরাতের মুক্তির জন্য মুত্তাকী হওয়ার সর্বোচ্চ
চেষ্টা করা উচিত।