আত্মহত্যা |
দেশে মহামারীর মতো বাড়ছে আত্মহত্যা। বিশেষ করে করোনা মহামারীতে বিদ্যুৎ বেগে বাড়ছে আত্মহত্যা। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে চলমান মহামারীর মধ্যে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যার কারন
১)
মানসিক চাপ
আত্মহত্যার
প্রধান কারণই হলো মানসিক চাপ। সভ্যতার এই যুগে দিন দিন আমাদের যৌথ পরিবার গুলো
ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার গঠিত হচ্ছে। মানুষ একা একা বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে
যাচ্ছে। আগেকার দিনে যৌথ ফ্যামিলি তে যখন মানুষ বসবাস করত তখন মানসিক চাপ বেশিক্ষণ
স্থায়ী হতে পারত না। বর্তমানে মানুষ একাকী বসবাস করার কারণে মানসিক চাপ মানুষকে
ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। আর এই মানসিক চাপ যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে
যায় তখন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কারণ সেই মুহূর্তে তার হিতাহিত জ্ঞান বলতে
কিছুই থাকেনা।
২)
পারিবারিক অশান্তি
আত্মহত্যার একটি অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক অশান্তি।
সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের জীবন প্রতিনিয়ত নানা দুঃখকষ্ট, হতাশা, বেদনার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়। অনেক সময়
পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক অনটন, স্বামী-স্ত্রীর
মাঝে বোঝাপড়ার অভাব, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, সম্পদের অসম বন্টন ইত্যাদি নানা কারণে পরিবারে অশান্তি লেগে থাকে। এই
অশান্তি থেকে ধীরে ধীরে তা সংঘাত অথবা মারাত্মক মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেই মুহূর্তে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
৩)
মাদক
মাদক
এমন একটি বিধ্বংসী ব্যাধি যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। চরম মাত্রায়
মাদকাসক্ত ব্যক্তি আত্ম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেকে নেশায় আসক্ত হয়ে
আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আত্মহত্যার পরিণাম
১) নিজের কাছে হেরে যাওয়া
পৃথিবীতে
মানুষ একমাত্র জীব যাকে সৃষ্টিকর্তা স্বাধীন কাজ করার ইচ্ছাশক্তি দিয়েছে যার
কারণে প্রাণী হিসেবে সকল সৃষ্টির উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ। শত দুঃখ কষ্ট হতাশা বেদনার
পরে ও মানুষ যখন জীবন যুদ্ধে টিকে থাকে তখনই একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া
যায়। কিন্তু দুঃখ-কষ্টে যখন টিকে থাকতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এর দ্বারা
এটাই প্রমাণিত হয় সে ব্যক্তি নিজের কাছেই নিজে হেরে যায়।
২) পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া
আত্মহত্যার
একটি অন্যতম পরিনাম হলো একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেকে ধ্বংস
করে না বরং একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। পরিবারের সদস্যরা মানসিক, সামাজিক,
অর্থনৈতিক নানা চাপ এর মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করে। পরিবার কর্তার
এমন একটি বিধ্বংসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যরা পথে বসতে বাধ্য হয়।
অনেক সময় পরিবার প্রধান আত্মহননের মাধ্যমে সন্তানরা যখন উপযুক্ত অভিভাবক হারা হয়
তখন অনেক সময় তারা নানা প্রকার অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
৩) ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
ধর্মীয়
দৃষ্টিকোণ থেকেও আত্মহত্যা একটি মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নানা
প্রকার রোগ শোক বিপদ আপদ দিয়ে পরীক্ষা করে থাকেন।
সুরা
বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন
وَلَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ
وَالۡجُوۡعِ وَنَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَالۡاَنۡفُسِ وَالثَّمَرٰتِ ؕ
وَبَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ ۙ
এবং
অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও
জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। (বাকারা ২:১৫৫)
কেউ এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তখন সে আল্লাহর কাছে
বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। কিন্তু সে পরীক্ষায় হেরে গিয়ে যারা নিজেকে শেষ করে
দেয় তারা আল্লাহর কাছে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন।
সূরা
নিসায় আল্লাহ তা'আলা বলেন
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا
اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ
تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ ۟ وَلَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ
بِکُمۡ رَحِیۡمًا
হে
ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের
পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা
করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। (সূরা নিসা ৪:২৯)
আত্মহত্যা বিষয়ে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম
এর অনেকগুলো হাদিসের মধ্যে একটি হাদিস হলো
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أُرَاهُ رَفَعَهُ قَالَ
" مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
وَحَدِيدَتُهُ فِي يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِي بَطْنِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ
خَالِدًا مُخَلَّدًا أَبَدًا وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِسُمٍّ فَسُمُّهُ فِي يَدِهِ
يَتَحَسَّاهُ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا أَبَدًا " .
আবূ
হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আবূ
হুরাইরা (রাঃ) মারফূভাবে বর্ননা করেনঃ যে লোক লোহার অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে ঐ লৌহঅস্ত্র
হাতে নিয়ে কিয়ামত দিবসে হাজির হবে। সে নিজের পেটে এতা অবিরত ভাবে বিদ্ধ করতে থাকবে
এবং সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। যে লোক বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে ঐ বিষ হাতে নিয়ে কিয়ামত দিবসে হাযির হবে। সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে
এবং সর্বদা এই বিষ গলাধঃকরণ করতে থাকবে।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ
(৩৪৬০) বুখারী, মুসলিম।
জামে' আত-তিরমিজি,
হাদিস নং ২০৪৩
আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায়
১)
কাউন্সেলিং
মানসিক
অশান্তি একটি ব্যাধি। শারীরিক রোগের যেমনি ভাবে চিকিৎসা প্রয়োজন হয় তেমনি ভাবে
মানসিক রোগের চিকিৎসা জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ ক্ষতিকর না হলেও অনেক
ক্ষেত্রে তা ধীরে ধীরে আত্মহননের দিকে নিয়ে যায়। তাই মানসিক অশান্তি থেকে বাঁচতে
আমাদেরকে সাইক্রেটিস্ট এর কাছে গিয়ে প্রপার কাউন্সেলিং করাতে হবে। পরামর্শদাতাদের
পরামর্শ, মোটিভেশন, উপদেশ এর মাধ্যমে একজন হতাশাগ্রস্ত
ব্যক্তি কে বুঝাতে হবে দুঃখ কষ্ট জীবনের একটি অংশ কিন্তু জীবনের সবকিছু নয়।
পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা
কুরআনেও বলেছেন। সূরা আল ইমরান এর ১৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন
وَشَاوِرۡہُمۡ فِی
الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ
الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ
এবং
কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন
আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন। (
২)
কর্মব্যস্ততা
যখন
মানুষ একাকী হয় তখনই মানুষকে হতাশা চেপে ধরে। তাইতো জরিপে দেখা যায় কর্মব্যস্ত
মানুষের তুলনায় একাকী বসবাসকারী মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। পবিত্র
কুরআনের সূরা ইনশিরাহ এর ৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন
فَاِذَا فَرَغۡتَ فَانۡصَبۡ ۙ
অতএব, যখন অবসর পান
পরিশ্রম করুন। (সূরা ইনশিরাহ ৯৪:৭)
৩)
ধর্মীয় অনুশাসন