যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি

যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি

যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি

যাকাত আরবী শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হল পবিত্র করা, বৃদ্ধি করা। শরীয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে তাদের সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করাকে যাকাত বলে। যেসব বিষয়কে ইসলামের মৌলিক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যাকাত সেগুলোর অন্যতম। পবিত্র কুরআনের প্রায় ৩২ যায়গায় যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ বার সালাতের সাথে যাকাতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা আলা সূরা বাক্বারায় বলেন,

وَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَارۡکَعُوۡا مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ

আর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়। (সূরা বাক্বারা ২:৪৩)

সূরা বাক্বারার অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ ؕ وَمَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ

তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। (সূরা বাক্বারা ২:১১০)

আজকের বিশ্বে মানবসভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষ প্রভুত অগ্রগতি সাধন করেছে। এর ফলে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অনেকের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। অন্য দিকে দুঃখজনকভাবে বিশ্বের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ দারিদ্র, অশিক্ষা স্বাস্থ্যহীনতা ও আশ্রয়ের অভাবে অতি দুঃখ-কষ্টে  দিন কাটাচ্ছে। বলাই বাহুল্য সম্পদ বন্টনে বৈষম্য ও শোষণ প্রক্রিয়ার নির্মম যাতাকলে নিস্পেষিত হয়ে এসব আদম  সন্তান বিপন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। 

এ চিত্র একেবারে নতুন নয়; যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন মতাদর্শের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও আজ বিশ্বে বষ্ণিত ও  হতভাগ্য মানুষের সংখ্যা কম নয়; বরং বেড়েই চলেছে। যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি আমাদের মাঝে চালু থাকলে  এ অবস্থার উন্নতি হত।  সুতরাং আজকের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। 

যাকাত প্রদান করার গুরুত্ব

যাকাত ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি বা বুনিয়াদ, যা অবশ্য পালনীয় (ফরয) ইবাদত। ইসলামের বুনিয়াদের মধ্যে ঈমান, সলাত ও সওম সকল মুসলমানের জন্যই অবশ্য পালনীয়, কিন্তু হজ্জ ও যাকাত শুধুমাত্র অর্থ- সম্পদের দিক দিয়ে সামর্থবান মুসলমানদের উপর ফরয। আর্থিক সামর্থবান বলতে যাকাতযোগ্য (নিসাব পরিমান) সম্পদের মালিক হওয়াকে বুঝায়। যাকাত ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার। আল্লাহ তাআলা বলেন,   

وَفِیۡۤ اَمۡوَالِہِمۡ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَالۡمَحۡرُوۡمِ

এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল। (সূরা জারিয়াত ৫১:১৯)

প্রিয়নবী (সাঃ) এই বিষয়ে বলেন,

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ الْمُسْنَدِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو رَوْحٍ الْحَرَمِيُّ بْنُ عُمَارَةَ، قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ وَاقِدِ بْنِ مُحَمَّدٍ، قَالَ سَمِعْتُ أَبِي يُحَدِّثُ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ

ইব্‌নু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষন না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রসূল, আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করলো; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫, মুসলিম ১/৮ হাঃ ২২, আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ২৪)

যাকাত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড

ইসলামী জীবনব্যবস্থার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হল যাকাত। এর অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সম্পদের সুষম  বন্টন। উপরন্তু সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার জন্যও ইসলাম প্রত্যেক মুসলিমকে তাকীদ প্রদান করে। এজন্যে  ইসলাম যে সকল ব্যবস্থা মানুষকে উপহার দিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে যাকাত। মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়লে সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। এসব সমস্যা থেকে মানব জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে আল্লাহ  তায়ালা প্রত্যেক ধনী মুসলমান ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। 

যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি

যাকাত বা সাদাকা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উপায় এবং এর দ্বারা সম্পদ পবিত্র হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ صَدَقَۃً تُطَہِّرُہُمۡ وَتُزَکِّیۡہِمۡ بِہَا وَصَلِّ عَلَیۡہِمۡ ؕ اِنَّ صَلٰوتَکَ سَکَنٌ لَّہُمۡ ؕ وَاللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন। (সূরা আত তাওবাহ ৯:১০৩)

 যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে

সঠিক নিয়মে যাকাত আদায় করার মাধ্যমে সম্পদের অবশিষ্ট অংশ পবিত্র হয়। হাদিস শরিফে এসেছে,

حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَعْلَى الْمُحَارِبِيُّ، حَدَّثَنَا أَبِي، حَدَّثَنَا غَيْلاَنُ، عَنْ جَعْفَرِ بْنِ إِيَاسٍ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا نَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ ‏{‏ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ ‏}‏ قَالَ كَبُرَ ذَلِكَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ فَقَالَ عُمَرُ - رضى الله عنه أَنَا أُفَرِّجُ عَنْكُمْ ‏.‏ فَانْطَلَقَ فَقَالَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ إِنَّهُ كَبُرَ عَلَى أَصْحَابِكَ هَذِهِ الآيَةُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَفْرِضِ الزَّكَاةَ إِلاَّ لِيُطَيِّبَ مَا بَقِيَ مِنْ أَمْوَالِكُمْ وَإِنَّمَا فَرَضَ الْمَوَارِيثَ لِتَكُونَ لِمَنْ بَعْدَكُمْ ‏"‏ ‏.‏ فَكَبَّرَ عُمَرُ ثُمَّ قَالَ لَهُ ‏"‏ أَلاَ أُخْبِرُكَ بِخَيْرِ مَا يَكْنِزُ الْمَرْءُ الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ إِذَا نَظَرَ إِلَيْهَا سَرَّتْهُ وَإِذَا أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ وَإِذَا غَابَ عَنْهَا حَفِظَتْهُ ‏"‏ ‏.‏

ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হলো : যারা সোনা-রুপা সঞ্চিত করে রাখে  (সূরাহ আত-তাওবাহ : ৩৪), মুসলমানদের উপর তা ভারী মনে হলো। তখন উমার (রাঃ) বললেন, আমিই তোমাদের পক্ষ হতে এর সুষ্ঠু সমাধান নিয়ে আসবো। অতঃপর তিনি গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী ! এ আয়াতটি আপনার সঙ্গীদের উপর কষ্টকর অনুভূত হচ্ছে। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ নিশ্চয় মহান আল্লাহ তোমাদের অতিরিক্ত মাল পবিত্র করার জন্যই যাকাত ফারয করেছেন। আর তিনি উত্তরাধিকারীর ব্যবস্থা ফারয করেছেন এজন্যই যেন তা তোমাদের পরবর্তীদের জন্য থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর উমার (রাঃ) আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেনঃ আমি কি তোমাকে মানুষের সর্বোত্তম সম্পদ সম্পর্কে অবহিত করবো না? তা হলো, নেককার স্ত্রী। সে তার দিকে তাকালে সে তাকে আনন্দ দেয় এবং তাকে কোন নির্দেশ দিলে সে তা মেনে নেয় এবং সে যখন তার থেকে অনুপস্থিত থাকে, তখন সে তার সতীত্ব ও তার সম্পদের হিফাযাত করে। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৬৬৪

সূরা রুমে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَاۤ اٰتَیۡتُمۡ مِّنۡ رِّبًا لِّیَرۡبُوَا۠ فِیۡۤ اَمۡوَالِ النَّاسِ فَلَا یَرۡبُوۡا عِنۡدَ اللّٰہِ ۚ وَمَاۤ اٰتَیۡتُمۡ مِّنۡ زَکٰوۃٍ تُرِیۡدُوۡنَ وَجۡہَ اللّٰہِ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُضۡعِفُوۡنَ

মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, অতএব, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে। (সূরা রুম ৩০:৩৯)

যাকাত না দেয়ার পরিণাম

অনেকেই সম্পদের মায়ায় পড়ে যাকাত আদায় করে না, যার দ্বারা অন্যের সম্পদ অন্যায় ভাবে ভোগ করার পাপে লিপ্ত থাকছে। যাদের জন্য কঠোর আজাবের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ সূরা তাওবাহতে বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَالرُّہۡبَانِ لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَیَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ  وَالَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّہَبَ وَالۡفِضَّۃَ وَلَا یُنۡفِقُوۡنَہَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۙ  فَبَشِّرۡہُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ۙ یَّوۡمَ یُحۡمٰی عَلَیۡہَا فِیۡ نَارِ جَہَنَّمَ فَتُکۡوٰی بِہَا جِبَاہُہُمۡ وَجُنُوۡبُہُمۡ وَظُہُوۡرُہُمۡ ؕ ہٰذَا مَا کَنَزۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ فَذُوۡقُوۡا مَا کُنۡتُمۡ تَکۡنِزُوۡنَ

হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। (সূরা তাওবাহ ৯:৩৪-৩৫)

যাকাত আদায় না করার পরিণাম প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، حَدَّثَنَا هَاشِمُ بْنُ الْقَاسِمِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ السَّمَّانِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ ـ يَعْنِي شِدْقَيْهِ ـ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كَنْزُكَ ‏"‏ ثُمَّ تَلاَ ‏{‏لاَ يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ‏}‏ الآيَةَ‏.‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, ক্বিয়ামাতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুপার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিলাওয়াত করেনঃ আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই ক্বিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে (আল-ইমরানঃ ১৮০)(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৪০৩)

ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত

যে ব্যক্তি যে জিনিসের ব্যবসা করবে তাকে ঐ সব জিনিসের যাকাত আদায় করতে হবে। রাসূল (সাঃ) ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত সম্পর্কে বলেন,

وَعَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - يَأْمُرُنَا; أَنْ نُخْرِجَ الصَّدَقَةَ مِنَ الَّذِي نَعُدُّهُ لِلْبَيْعِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ، وَإِسْنَادُهُ لَيِّنٌ

সামুরাহ বিন জুনদূৰ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নির্দেশ দিতেন ঐসকল সম্পদ হতে সদাকাহ বের করতে যেগুলো আমরা বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করতাম। -এর সানাদে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে। (বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ৬২৩)

ফুটনোটঃ

আবু দাউদ হাঃ ১৫৬২। ইমাম সনআনী সুবুলুস সালাম (২/২১৪) গ্রছে বলেন, এর সনদে সুলায়মান বিন সামরাহ নামক মাজহুল রাবী রয়েছে। ইমাম শওকানী আস-সাইলুল জাররার (২/২৭) গ্রন্থে বলেন, এর সনদে একাধিক মাজহুল রাবী রয়েছে। ইবনুল কাত্তান আল ওয়াহম ওয়াল ইহাম (৫/১৩৯) গ্রন্থে বলেন, এর সনদের রাবী খুৰাইৰ বিন সুলাইমান বিন সামরাহ ও তার পিতাকে তার সমসাময়িক কেউ চিনতেন না। ইমাম যাহাৰী মিযানুল ইতিদাল (১/৪০৭) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটি অস্পষ্ট। ইমাম যাহাবী তানকীহুত তাহকীক (১/৩৪৬) গ্রন্থে এর সনদকে লীন উল্লেখ করেছেন।

স্বর্ণ রৌপ্য ও অলংকারের যাকাত

স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যবসা বা অলংকার যে কোন অবস্থায় থাকুক না কেন, তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয।

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، أَنَّ امْرَأَتَيْنِ، أَتَتَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَفِي أَيْدِيهِمَا سُوَارَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهُمَا ‏"‏ أَتُؤَدِّيَانِ زَكَاتَهُ ‏"‏ ‏.‏ قَالَتَا لاَ ‏.‏ قَالَ فَقَالَ لَهُمَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ أَتُحِبَّانِ أَنْ يُسَوِّرَكُمَا اللَّهُ بِسُوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ ‏"‏ ‏.‏ قَالَتَا لاَ ‏.‏ قَالَ ‏"‏ فَأَدِّيَا زَكَاتَهُ ‏"‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى وَهَذَا حَدِيثٌ قَدْ رَوَاهُ الْمُثَنَّى بْنُ الصَّبَّاحِ عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ نَحْوَ هَذَا ‏.‏ وَالْمُثَنَّى بْنُ الصَّبَّاحِ وَابْنُ لَهِيعَةَ يُضَعَّفَانِ فِي الْحَدِيثِ وَلاَ يَصِحُّ فِي هَذَا الْبَابِ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم شَيْءٌ ‏.‏

আমর ইবনু শুআইব (রহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণিতঃ দুইজন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসে। তাদের দুজনের হাতে স্বর্ণের বালা ছিল। তিনি তাদের উভয়কে প্রশ্ন করেনঃ তোমরা কি এর যাকাত প্রদান কর। তারা বলল, না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে বললেনঃ তোমরা কি এটা পছন্দ কর যে, আল্লাহ তাআলা (কিয়ামাতের দিন) তোমাদের আগুনের দুটি বালা পরিয়ে দিবেন? তারা বলল, না। তিনি বললেনঃ তবে তোমরা এর যাকাত প্রদান কর। জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৬৩৭, অন্য শব্দে হাদীসটি হাসান, ইরওয়া (৩/২৯৬), মিশকাত (১৮০৯), সহীহ আবূ দাঊদ (১৩৯৬)

ফুটনোটঃ

আবূ ঈসা বলেন, মুসান্না ইবনুস সাব্বাহ ও ইবনু লাহীআও আমর ইবনু শুআইবের নিকট হতে উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা উভয়ে হাদীস শাস্ত্রে যঈফ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট হতে এ ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয়নি।

উৎপাদিত ফসলের যাকাত বা উশর

উৎপাদিত ফসল যদি সংরক্ষণ যোগ্য হয় এবং তার পরিমাণ সর্বনিম্ন প্রায় চব্বিশ মণ হয় তাহলে তার উপর উশর  আদায় করা আবশ্যক হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এসেছে

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا کَسَبۡتُمۡ وَمِمَّاۤ اَخۡرَجۡنَا لَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ ۪ وَلَا تَیَمَّمُوا الۡخَبِیۡثَ مِنۡہُ تُنۡفِقُوۡنَ وَلَسۡتُمۡ بِاٰخِذِیۡہِ اِلَّاۤ اَنۡ تُغۡمِضُوۡا فِیۡہِ ؕ وَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ حَمِیۡدٌ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাব মুক্ত, প্রশংসিত। (সূরা বাক্বারা ২:২৬৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,  

وَہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَ جَنّٰتٍ مَّعۡرُوۡشٰتٍ وَّغَیۡرَ مَعۡرُوۡشٰتٍ وَّالنَّخۡلَ وَالزَّرۡعَ مُخۡتَلِفًا اُکُلُہٗ وَالزَّیۡتُوۡنَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِہًا وَّغَیۡرَ مُتَشَابِہٍ ؕ  کُلُوۡا مِنۡ ثَمَرِہٖۤ اِذَاۤ اَثۡمَرَ وَاٰتُوۡا حَقَّہٗ یَوۡمَ حَصَادِہٖ ۫ۖ  وَلَا تُسۡرِفُوۡا ؕ  اِنَّہٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ ۙ

তিনিই উদ্যান সমূহ সৃষ্টি করেছে-তাও, যা মাচার উপর তুলে দেয়া হয়, এবং যা মাচার উপর তোলা হয় না এবং খর্জুর বৃক্ষ ও শস্যক্ষেত্র যেসবের স্বাদবিশিষ্ট এবং যয়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন-একে অন্যের সাদৃশ্যশীল এবং সাদৃশ্যহীন। এগুলোর ফল খাও, যখন ফলন্ত হয় এবং হক দান কর কর্তনের সময়ে এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা আনআম ৬:১৪১)

বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ, আর যদি পানি সেচ দ্বারা চাষাবাদ হয়, তবে বিশ ভাগের এক ভাগ তথা নিসফে উশর দিতে হবে। হাদীসে এসেছে,

حَدَّثَنَا إِسْحَقُ بْنُ مُوسَى أَبُو مُوسَى الْأَنْصَارِيُّ حَدَّثَنَا عَاصِمُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ عَاصِمٍ حَدَّثَنَا الْحَارِثُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي ذُبَابٍ عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ يَسَارٍ وَعَنْ بُسْرِ بْنِ سَعِيدٍ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيمَا سَقَتْ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ الْعُشْرُ وَفِيمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ বৃষ্টির পানি অথবা ঝর্ণার পানি সিক্ত জমিনের উৎপন্ন ফসলের এক-দশমাংশ এবং পানি সেচ দ্বারা সিক্ত জমিনের উৎপন্ন ফসলের এক-বিংশতি অংশ যাকাত দিতে হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৮১৬)

যাকাত আদায়ের শর্ত

(ক)     নিসাব পরিমাণ মাল হওয়া

কারও মালিকানায় যদি তার নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু বাদ দিয়ে সাড়ে সাত তোলা (ভরি) স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (ভরি) রৌপ্য অথবা এর সম পরিমাণ অন্য কোন সম্পদ গচ্ছিত থাকে তাহলে ঐ পরিমাণ সম্পদকে নিসাব বলে। হাদীসে নিসাব সম্পর্কে এসেছে,

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي صَعْصَعَةَ الْمَازِنِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ مِنَ التَّمْرِ صَدَقَةٌ، وَلَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسِ أَوَاقٍ مِنَ الْوَرِقِ صَدَقَةٌ، وَلَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسِ ذَوْدٍ مِنَ الإِبِلِ صَدَقَةٌ ‏"‏‏.‏

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, পাঁচ ওসাক-এর কম পরিমাণ খেজুরের যাকাত নেই। পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যের যাকাত নেই এবং পাঁচটির কম উটের যাকাত নেই। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৪৫৯)

উল্লেখ্য পাঁচ ওসক সমান ৬০ সা যা আমাদের দেশীয় ওজনে প্রায় ২৮মণ, পাঁচ উকিয়্যা সমান ২০০ দিরহাম তথা  সাড়ে বায়ান্ন তোলা (ভরি) বা ৬১২.১৫ গ্রাম।

(খ)     পূর্ণ এক বছর নিজ মালিকানায় থাকা

নিসাব পরিমাণ অর্থ এক বছর কারো মালিকানায় থাকলে তার উপর যাকাত আদায় ফরয হবে। এ প্রসঙ্গে রসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেন,

َدَّثَنَا نَصْرُ بْنُ عَلِيٍّ الْجَهْضَمِيُّ حَدَّثَنَا شُجَاعُ بْنُ الْوَلِيدِ حَدَّثَنَا حَارِثَةُ بْنُ مُحَمَّدٍ عَنْ عَمْرَةَ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَا زَكَاةَ فِي مَالٍ حَتَّى يَحُولَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ

আয়িশাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোন মালের যাকাত নেই। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৭৯২)

যাকাত আদায়ের খাতসমূহ

যাকাত আদায়ের খাত মোট আটটি। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَالۡمَسٰکِیۡنِ وَالۡعٰمِلِیۡنَ عَلَیۡہَا وَالۡمُؤَلَّفَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ وَفِی الرِّقَابِ وَالۡغٰرِمِیۡنَ وَفِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَابۡنِ السَّبِیۡلِ ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ اللّٰہِ ؕ وَاللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ

যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদে হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা আত তাওবাহ ৯:৬০)

যাকাত আদায় ও বন্টনের পদ্ধতি

উক্ত খাত সমূহের মধ্যে নিকট আত্মীয় ব্যক্তিবর্গ যাকাত পাওয়ার বেশি হকদার। নিজের ভাই-বোন ভাতিজা ভাগিনা, চাচা, চাচাত ভাই-বোন, মামা, মামাত ভাই-বোন ইত্যাদি আপনজনদের যাকাত দেয়া যাবে এবং এধরনের নিকটাত্মীয়দের দিলে দ্বিগুণ সওয়াব হবে বলে হাদীসে এসেছে,

أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الْأَعَلَى، قَالَ: حَدَّثَنَا خَالِدٌ، قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ عَوْنٍ، عَنْ حَفْصَةَ، عَنْ أُمِّ الرَّائِحِ، عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ الصَّدَقَةَ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الرَّحِمِ اثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ»

সালমান ইব্‌ন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মিসকীনকে দান করার মধ্যে শুধু সাদাকা (র সওয়াব রয়েছে) আর আত্নীয়-স্বজনকে দান করা দুটি (সওয়াব রয়েছে) দান করা (র সওয়াব) এবং আত্নীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা (র সওয়াব)(সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ২৫৮২)

এসব লোক এবং সম্মানিত ব্যক্তি যিনি দারিদ্রের কষ্টে থাকলেও লোকের কাছে সাহায্য চান না, তাদেরকে যাকাত দিতে যাকাত বলে দেয়া উচিত নয়। কারণ এতে তাদের মন ছোট হয়ে যায় । তবে যাকাত দাতা যাকাতের নিয়ত  করে তা প্রদান করবে। 

আবার আত্মীয়দের মধ্যে নিজের পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানী এবং তাদের উর্দ্ধে কাউকে দেয়া যাবে না।  তেমনি নিজ সন্তান এবং তাদের নিম্নের (নাতি-নাতনি বা তারও নিচের) কাউকে দেয়া যাবে না। স্ত্রীকেও যাকাত  দেয়া যাবে না। কোন ধনী এবং অমুসলিমকে যাকাত দিলে আদায় হবে না । 

বছর পূর্ণ হওয়ার আগেও (অগ্রিম) যাকাত দেয়া জায়েয আছে। যা বছরের শেষে সমন্বয় করে নেবে। হাদীসে এসেছে,

حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ مَنْصُورٍ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ زَكَرِيَّا، عَنِ الْحَجَّاجِ بْنِ دِينَارٍ، عَنِ الْحَكَمِ، عَنْ حُجَيَّةَ، عَنْ عَلِيٍّ، أَنَّ الْعَبَّاسَ، سَأَلَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي تَعْجِيلِ صَدَقَتِهِ قَبْلَ أَنْ تَحِلَّ فَرَخَّصَ لَهُ فِي ذَلِكَ ‏.‏ قَالَ مَرَّةً فَأَذِنَ لَهُ فِي ذَلِكَ ‏.‏ قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَرَوَى هَذَا الْحَدِيثَ هُشَيْمٌ عَنْ مَنْصُورِ بْنِ زَاذَانَ عَنِ الْحَكَمِ عَنِ الْحَسَنِ بْنِ مُسْلِمٍ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَحَدِيثُ هُشَيْمٍ أَصَحُّ ‏.‏

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ একদা আব্বাস (রাঃ) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট আগাম যাকাত দেয়ার আবেদন করলে তিনি তাকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৬২৪)

যাকাত এমন ভাবে প্রদান করতে হবে যাতে দারিদ্র দূর হয়। উল্লেখ্য আমাদের সমাজে যেভাবে শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে  যাকাত প্রদান করা হয়, সেভাবে অনন্তকাল যাকাত দিলেও দারিদ্র দূর হবে না। কারণ যাকে শাড়ি বা লুঙ্গি দেয়া  হয় তার মাত্র এক দিনের ভিক্ষাও বন্ধ হয় না। অথচ যাকাতের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার কথা । কিন্তু আমরা এমনভাবে যাকাত দেই যে, কারো একদিনের ভিক্ষাও বন্ধ করতে পারি না । যাকে দিলাম তার দরকার ডাল-চাল, ঔষধ বা টাকা । এমতাবস্থায় আমরা যদি তাকে শাড়ি-লুঙ্গি দেই তবে তার প্রয়োজন কীভাবে মিটবে? বরং আপনার দেয়া ৫০০ টাকা দামের শাড়ি সে ২০০ টাকা দিয়ে বিক্রি করে তার প্রয়োজন মিটাবে। এতে গরীবকে তার পাওনা থেকে ৩০০ টাকা করে কম দিয়ে যাকাত দিলেন। এজেন্য বিশ্বের অনেক ইমাম ও আলিম বলেন, এভাবে কাপড়  দিয়ে যাকাত দিলে যাকাত আদায়ই হবে না । কারণ রাসূল (সাঃ) বা সাহাবীগণ এভাবে দেননি । 

সবচেয়ে ভালো, এমনভাবে যাকাত দিন, যাতে একজন লোকের কর্মসংস্থান হয় । যাকে দেবেন তার প্রয়োজন  অনুসারে কিছু বড় অংকের অর্থ দিয়ে তার প্রয়োজন মিটান । কাউকে হালের বলদ, কাউকে রিক্সা-ভ্যান, কাউকে  লেখাপড়া বা চিকিৎসার খরচ যার যেটি প্রয়োজন তাকে সেটি দিন । একজনের যাকাত অনেক লোককে বণ্টন করার  চেয়ে কম লোককে এমনভাবে দিন যাতে তাদের আর ভিক্ষা করতে না হয় । বরং তারাও আস্তে আস্তে সাবলম্বি হবে

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

স্থাবর সম্পত্তি, উপার্জনের হাতিয়ার-যন্ত্রপাতি, পচনশীল কৃষিপণ্য, চলাচলের জন্তু বা যানবাহন, ব্যবহারের কাপড়চোপড়, অফিসের আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি এবং জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ বাদ দিয়ে সাড়ে ৭ তোলা (ভরি) বা ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ ভরি (৫৯৫ গ্রাম) রৌপ্য বা এর কোনটার মূল্য পরিমাণ সম্পদ কারো কাছে ১ বছর থাকলে তাকে বছর শেষে ৪০ ভাগের ১ ভাগ বা ২.৫% মাল যাকাত দিতে হবে। সোনা রূপার অলংকারের যাকাত দিতে হবে।

কারো মালিকানাধীন বিভিন্ন মাল মিলিয়েই হিসেব করতে হবে। যেমন, ডিপিএস, বীমা, ব্যাংকের যাবতীয় একাউন্ট, ঘরে-বাহিরের যেসব টাকা আছে, দোকানের মাল, অন্যের কাছে পাওনা অর্থ সবই হিসেবে আসবে। আবার নিজে কারো দেনা থাকলে সেটা মোট হিসেব থেকে বাদ যাবে। অবশ্য কিস্তিতে দেনা হলে এবছর যা পরিশোধ করবেন তা বাদ যাবে। বছরের মাঝখানে সম্পদ বাড়লে বা কমলেও বছর শেষে যে পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার যাকাত দিতে হবে।

  • ü ব্যবসার জন্যে যে জমি কিনে রাখা হয়েছে তার বর্তমান বাজার মূল্যের উপর যাকাত দিতে হবে।
  • ü ভাড়া দেয়া বাড়ি-ঘরে যাকাত আসবে না, তবে তার ভাড়ার উপর যাকাত আসবে।
  • ü ভাড়া দেয়া গাড়ির যাকাত আসবে না, তবে তার ভাড়ার উপর যাকাত আসবে।
  • ü প্লট বা অন্য জমি যদি বিক্রি করা বা ব্যবসার জন্য রাখা হয় তবে তার যাকাত দিতে হবে। কিন্তু নিজে বসবাস করার জন্য রাখা হলে জাকাত দিতে হবে না।
  • ü ইনকাম টেক্সের সাথে যাকাতের কোন সম্পর্ক নেই। ইনকাম টেক্স দেয়ার কারনে যাকাত মাফ হবেনা।

শেষ কথা

আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের দারিদ্র দূর করার জন্য কার্যকর ও টেকসই কৌশল হচ্ছে যাকাত ব্যবস্থা। যাকাত  বিতরণের মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের নির্ধারিত অংশ অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ দরিদ্রদের কাছে সম্পদ হিসেবে  হস্তান্তর করে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের  দক্ষতাকে বৃদ্ধি করতে হবে এবং এভাবে তাদেরকে সমাজের এক একজন কর্মক্ষম ও সৃজনশীল জনশক্তিতে পরিণত  করতে হবে।

সূতরাং আসুন যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি কুরআন হাদীসের আলোকে আমরা জানি। যাকাত ভিত্তিক সমাজ  কায়েমের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করি। আমাদের দেশটির হতভাগ্য মানুষের পাশে দাঁড়াই, তাদের দুঃখ-দূর্দশা উপলদ্ধি  করার চেষ্টা করি এবং সুপারিকল্পিতভাবে যাকাত আদায় করি এবং বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে দারিদ্র্য বিমোচনে  অবদান রাখি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে যাকাত আদায়ের সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করার তাওফিক দান  করুন।

 

পিডিএফ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন।