কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইতিকাফ

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইতিকাফ

কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইতিকাফ

ইতিকাফ মাহে রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইতিকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামও ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহর জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করেন। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত কামনা করে বিশেষ দোয়া করে থাকেন।

সংজ্ঞা

ইতিকাফআরবি শব্দ। এর অর্থ হলো অবস্থান করা, আবদ্ধ করা বা আবদ্ধ রাখা। ইসলামি পরিভাষায় ইতিকাফ হলো ইবাদতের উদ্দেশ্যে ইতিকাফের নিয়তে নিজেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবদ্ধ রাখা। যিনি ইতিকাফ করেন, তাকে মুতাকিফ বলে।

কুরআনের ভাষায় ইতিকাফ

ইতিকাফ শব্দটি মহান আল্লাহ তা'আলা সূরা আম্বিয়াতে উল্লেখ করেন এভাবে,

مَا هَذِهِ التَّمَاثِيْلِ الَّتِيْ أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُوْنَ

অর্থাৎ, (ইবরাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল,) যে মূর্তিগুলোর পূজায় তোমরা রত আছ, (বা যাদের পূজারী হয়ে বসে আছ) সে গুলো কি? (অর্থাৎ, তোমরা তাদের সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে পূজায় রত আছ।) (সূরা আম্বিয়া ২১:৫২)

ইতিকাফ কারীদের জন্য কাবা ঘরকে পবিত্র রাখার আদেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ

অর্থাৎ, (আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে অঙ্গীকারবদ্ধ করলাম যে,) তোমরা উভয়ে আমার (কাবা) গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (সূরা বাকারা ২:১২৫)

ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী-গমন করা বিষয়ে আল্লাহর নিষেদাজ্ঞা

وَلاَ تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ

অর্থাৎ, আর মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তোমরা স্ত্রী-গমন করো না। (সূরা বাকারা ২:১৮৭)

ইতিকাফ বিষয়ে রসূল সাঃ এর হাদিস শরিফ

রসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি রমজানে দশদিনের ইতিকাফ করতেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا‏.‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রমযানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন। (সহিহুল বুখারী ২০৪৪)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সহধর্মিণীগণও ইতিকাফ করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ‏.‏

নবী সহধর্মিণী আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন। (সহিহুল বুখারী ২০২৬)

ইতিকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ইতিকাফের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো লাইলাতুল ক্বদর অনুসন্ধান করা। যে ব্যক্তি পবিত্র মাহে রমযানের শেষ ১০দিন ইতিকাফ করবেন, তিনি নিশ্চয়ই লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করবেনই। প্রত্যেক ইবাদতের পশ্চাতে রহস্য, হিকমত ও যৌক্তিকতা আছে একাধিক। এ কথা বিদিত যে, প্রত্যেক আমল হৃদয়ের উপর নির্ভরশীল। রোযা যেমন পানাহার ও যৌনাচার-জনিত কুপ্রবৃত্তির নানা প্রতিবন্ধক থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের পক্ষে ঢালস্বরূপ। ঠিক তেমনি ইতিকাফও বিরাট রহস্য-বিজড়িত একটি ইবাদত। ইতিকাফ মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত মিলামিশার ফলে হৃদয়ে যে কুপ্রভাব পড়ে এবং অতিকথা ও অতিনিদ্রার ফলে মহান প্রতিপালকের সাথে সম্পর্কে যে ক্ষতি হয় তার হাত হতে রক্ষা করে। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অতিবন্ধুত্ব, অতিকথা এবং অতিনিদ্রার কবল থেকে মুক্তি পাওয়াতেই রয়েছে বান্দার বড় সাফল্য; যে সাফল্য তার হৃদয়কে আল্লাহর পথে অগ্রসর হতে শক্তি যোগায় এবং এর প্রতিকূল সকল অবস্থা থেকে তাকে নিরাপত্তা প্রদান করে।

কদর তালাশ করা

ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হল লাইলাতুল কদর তালাশ করা। আলোচ্য হাদিস শরিফে যেমনি বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، وَيَقُولُ ‏ "‏ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‏"‏‏.‏

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২০২০)

ফুটনোটঃ

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমের সূরা ক্বদরে ঘোষণা করেছেন- লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের (ইবাদাতের) চেয়েও উত্তম। সহীহ শুদ্ধ হাদীস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীসে এ কথাও উল্লেখিত আছে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিজোড় রাত্রিতেই তা হয় না। (অর্থাৎ কোন বছরে ২৫ তারিখে হল, আবার কোন বছরে ২১ তারিখে হল এভাবে। আমাদের দেশে সরকারী আর বেসরকারীভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদর সাব্যস্ত করার কোনই হাদীস নাই। লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে।

বর্তমানে রাত্রি জাগরণের জন্য মসজিদে সকলে সমবেত হয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের যে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সেটিও নবাবিষ্কৃত কাজ। কারণ আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সময়ে সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে জাগরিত হয়ে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইবাদত না করে নিজ নিজ পরিবারকে জাগিয়ে কিয়ামুল লাইল পালন করতেন।

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُجَاوِرُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ وَيَقُولُ ‏"‏ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‏"‏

আইশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রমযান মাসের শেষের দশদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাসজিদে থাকতেন (ইতিকাফ করতেন)। তিনি বলতেনঃ রমযান মাসের শেষের দশদিন তোমরা কাদরের রাতকে খোঁজ কর। (জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৭৯২)

ফুটনোটঃ

উমার, উবাই ইবনু কাব, জাবির ইবনু সামুরা, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ, ইবনু উমার, ফালাতান ইবনু আসিম, আনাস, আবূ সাঈদ, আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস, আবূ বাক্‌রা, ইবনু আব্বাস, বিলাল ও উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) হতেও এই অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। আবূ ঈসা আইশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। ইউজাবিরু শব্দের অর্থ তিনি ইতিকাফ করতেন। এই ক্ষেত্রে বেশিরভাগ হাদীসের শব্দ হচ্ছেঃ শেষ দশদিনের প্রতি বিজোড় রাত্রে তোমরা লাইলাতুল কাদর খোঁজ কর। লাইলাতুল কাদর প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত আছে যে, তা হল একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাতাশ, ঊনত্রিশ বা রমযানের শেষরাত্র।

   ইমাম শাফিঈ (রহঃ) বলেন, আমার মতে এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেভাবেই উত্তর প্রদান করতেন তাঁকে যেভাবে প্রশ্ন করা হত। তাঁর কাছে কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করেছে, অমুক রাত্রে কি আমরা তা খোঁজ করব? উত্তরে তিনি বলেছেন, তোমরা অমুক রাত্রে তা খোঁজ কর। ইমাম শাফিঈ (রহঃ) আরও বলেন, আমার নিকটে একুশ তারিখ সম্পর্কিত রিওয়ায়াতটি হচ্ছে এ বিষয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী। আবূ ঈসা বলেন, উবাই ইবনু কাব (রাঃ) শপথ করে বলতেনঃ তা হল সাতাশ তারিখের রাত্রি।

 তিনি আরও বলতেন, এর আলামত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন এবং তা আমরা হিসাব করে রেখেছি এবং স্মরণ রেখেছি।

আবূ কিলাবা (রাঃ) বলেন, লাইলাতুল কাদর শেষ দশকের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে। আব্‌দ ইবনু হুমাইদ আবদুর রাযযাক হতে, তিনি মামার হতে, তিনি আইয়ূব হতে, তিনি আবূ কিলাবা (রাঃ) হতে এই বক্তব্যটি বর্ণনা করেছেন।

ইতিকাফের ফজিলত ও জরুরী বিধি-বিধান

মহান আল্লাহ মাহে রমযান দ্বারা মুসলিম জাতিকে যেমনি সম্মানিত করেছেন, তেমনি অসহায় সম্বলহীন, হতদরিদ্র, নিঃস্ব ব্যক্তির জন্যে শুক্রবার দান করে হজ্বের ছওয়াব দান করেছেন। আরবি ইতিকাফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা, বসা, বিশ্রাম করা, সাধনা করা, ধ্যান করা ইত্যাদি। রমযানের ২১তম রাত হতে ২৯তম রাত পর্যন্ত সাংসারিক যাবতীয় ঝামেলা হতে মুক্ত হয়ে মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। রমযানের শেষ ১০দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা-ই-কিফায়া। মহল্লার কোনো একজন ইতিকাফ পালন করলে সবার পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়। আর মহল্লার কেউ যদি ইতিকাফ না করেন তবে সবাই সুন্নাত ত্যাগের জন্যে দায়ী থাকবেন এবং গুণাহগার হবেন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) পবিত্র মাহে রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।

মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে ব্যক্তি দুটি হজ্ব ও দুটি ওমরাহর সমান সওয়াব হাসিল করবে (বায়হাকি)।

মহানবী (সাঃ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি ইবাদতের নিয়তে সওয়াবের আশায় ইতিকাফ করবেন তার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায় (দায়লামী)।

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ وَيُجْرَى لَهُ مِنْ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেন, সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। (মিশকাত ২১০৮, ইবনে মাজাহ ১৭৮১)

وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مَا لَا يَجْتَهِدُ فِىْ غَيْرِه. رَوَاهُ مُسْلِمٌ

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান মাসের শেষ দশ দিনে যত ইবাদাত বন্দেগী (মুজাহাদাহ্) করতেন এতো আর কোন মাসে করতেন না। (মুসলিম ১১৭৫, তিরমিযী ৭৯৬, ইবনু মাজাহ ১৭৬৭, আহমাদ ২৬১৮৮, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২১৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৬১, সহীহাহ্ ১১২৩, সহীহ আল জামি ৪৯১০, মিশকাতুল মাসাবিহ ২০৮৯)

ইতিকাফকারীর করণীয় ও বর্জনীয়

وَعَن عَائِشَة رَضِي الله عَنْهَا قَالَتْ: السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لَا يَعُودَ مَرِيضًا وَلَا يَشْهَدُ جِنَازَةً وَلَا يَمَسُّ الْمَرْأَةَ وَلَا يُبَاشِرُهَا وَلَا يَخْرُجُ لِحَاجَةٍ إِلَّا لِمَا لَابُدً مِنْهُ وَلَا اِعْتِكَافَ إِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا فِىْ مَسْجِدٍ جَامِعٍ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য এ নিয়ম পালন করা জরুরী- (১) সে যেন কোন রোগী দেখতে না যায়। (২) কোন জানাযায় শারীক না হয়। (৩) স্ত্রী সহবাস না করে। (৪) স্ত্রীর সাথে ঘেঁষাঘেষি না করে। (৫) প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজে বের না হয়। (৬) সওম ছাড়া ইতিকাফ না করে এবং (৭) জামি মাসজিদ ছাড়া যেন অন্য কোথাও ইতিকাফে না বসে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২১০৬, আবূ দাঊদ ২৪৭৩ )

অন্য হাদিসে এসেছে,

وَعَنْهَا قَالَتْ: السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لَا يَعُودَ مَرِيضًا، وَلَا يَشْهَدَ جِنَازَةً، وَلَا يَمَسَّ امْرَأَةً، وَلَا يُبَاشِرَهَا، وَلَا يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ، إِلَّا لِمَا لَا بُدَّ لَهُ مِنْهُ، وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اعْتِكَافَ إِلَّا فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ، وَلَا بَأْسَ بِرِجَالِهِ، إِلَّا أَنَّ الرَّاجِحَ وَقْفُ آخِرِهِ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য সুন্নাত বা শরয়ী ব্যবস্থা হচ্ছে তিনি কোন রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যাবেন না, জানাযায় শামিল হবেন না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তাকে জড়াবে না, প্রয়োজন থাকলেও (মসজিদ হতে) বের হবেন না তবে যা না হলে মোটেই চলবে না (যেমন পায়খানা ও পেশাব করার জন্যে); এবং সওম ব্যতীত ইতিকাফ হয় না এবং জুমুআহ মসজিদ ব্যতীত অন্যত্র ইতিকাফ হয় না- আবূ দাউদ। এর রাবীদের মধ্যে কোন ক্রটি নেই, তবে এর শেষাংশ মওকুফ হওয়াটাই সমিচীন (অর্থাৎ সওম ব্যতীত ইতিকাফ নেই হতে শেষাংশ রাবীর নিজস্ব কথা)। (বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ৭০২)

أَنَّ عَائِشَةَ، زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ إِنْ كُنْتُ لأَدْخُلُ الْبَيْتَ لِلْحَاجَةِ وَالْمَرِيضُ فِيهِ فَمَا أَسْأَلُ عَنْهُ إِلاَّ وَأَنَا مَارَّةٌ وَإِنْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيُدْخِلُ عَلَىَّ رَأْسَهُ وَهُوَ فِي الْمَسْجِدِ فَأُرَجِّلُهُ وَكَانَ لاَ يَدْخُلُ الْبَيْتَ إِلاَّ لِحَاجَةٍ إِذَا كَانَ مُعْتَكِفًا ‏.‏ وَقَالَ ابْنُ رُمْحٍ إِذَا كَانُوا مُعْتَكِفِينَ ‏.

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী আয়িশাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, (ইতিকাফের সময়) আমি যখন প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘরে প্রবেশ করতাম। ঘরে কোন রোগী থাকে তাহলেও তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস না করেই চলে যেতাম। ইতিকাফের সময় রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাসজিদ থেকে আমার দিকে মাথা এগিয়ে দিতেন, আর আমি তাঁর চুল আঁচড়ে দিতাম। ইতিকাফ থাকাবস্থায় তিনি (প্রাকৃতিক) কোন প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না।

ইবনু রুমহ্ বলেছেন: যখন তাঁরা ইতিকাফের অবস্থায় থাকতেন, প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৭২, ই.ফা. ৫৭৬, ই.সে. ৫৯২)

ইতিকাফের প্রকারভেদ

ইতিকাফ ৩ প্রকার।

১. ওয়াজিব ইতিকাফ,

২. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা,

৩. নফল ইতিকাফ।

ওয়াজিব ইতিকাফ:

যা মানত করার কারণে ওয়াজিব হয়। সে ইতিকাফ অবশ্যই পালন করতে হবে।

وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ عُمَرَ سَأَلَ النَّبِىَّ قَالَ: كُنْتُ نَذَرْتُ فِى الْجَاهِلِيَّةِ أَنْ أَعْتَكِفَ لَيْلَةً فِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ؟ قَالَ: «فَأَوْفِ بِنَذْرِكَ». (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একবার উমার  নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, (হে আল্লাহর রসূল!) জাহিলিয়্যাতের যুগে আমি এক রাতে মাসজিদে হারামে ইতিকাফ করার মানৎ করেছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার মানৎ পুরা করো। (বুখারী ২০৩২, মুসলিম ১৬৫৬, আহমাদ ২৫৫, সহীহ ইবনু হিববান ৪৩৮০, মিশকাতুল মাসাবিহ ২১০১)

   আবদুল্লাহ ইবনু আমর ও ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিকে আবূ ঈসা হাসান সহী্‌হ্‌ বলেছেন। এ হাদীস মোতাবিক কয়েকজন অভিজ্ঞ আলিম বলেছেন, যদি কোন লোক ইসলাম ক্ববূল করে এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্যমূলক কাজের মানত যদি তার উপর থেকে যায় তবে সে এ মানত পুরো করবে। নাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে) এর কয়েকজন সাহাবী ও তৎপরবর্তীগণ বলেছেন, তাকে রোযা সহকারে ইতিকাফ করতে হবে। তারা মনে করেন রোযা ব্যতীত ইতিকাফ সম্পন্ন হয় না। অপর কয়েকজন অভিজ্ঞ আলিম বলেছেন, ইতিকাফ আদায়কারীর জন্য রোযা রাখা জরুরী নয়। তবে সে লোক ইতিকাফের সাথে রোযা রাখার মানতও করলে তবে তাকে রোযাও আদায় করতে হবে। তাদের দলীলঃ উমার (রাঃ) মুসলমান হওয়ার আগে কাবা শরীফে এক রাত ইতিকাফের মানত করেছিলেন। তাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই মানত পুরো করার নির্দেশ দেন (অথচ রাতে রোযা হয় না সুতরাং রোযা ব্যতীতও ইতিকাফ হয়)। এই মত দিয়েছেন ইমাম আহমাদ ও ইসহাকও। (জামে' আত-তিরমিজিঃ ১৫৩৯)

সুন্নাতে মুয়াক্কাদা : যা মাহে রমযানে (লাইলাতুল কদরের সওয়াব অর্জনের জন্য) শেষ ১০ দিন করা হয়। যা আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরামগণ করেছেন। বর্তমানে সারা বিশ্বের বিশেষ করে প্রায় সব মসজিদের খতিব ও ইমাম সাহেবরা করে থাকেন।

عَنْ أَنَسٍ قَالَ: كَانَ النَّبِىُّ يَعْتَكِفُ فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ فَلَمْ يَعْتَكِفْ عَامًا. فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ. رَوَاهُ التِّرْمِذِىُّ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এক বছর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা করতে পারলেন না। এর পরের বছর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিশ দিন ইতিকাফ করলেন। (তিরমিযী ৮০৩, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২২৭, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৬০১, মিশকাতুল মাসাবিহ ২১০২)

নফল : নফল ইতিকাফের কোনো নির্ধারিত সময় নেই। যে কোনো মাসের যে কোনো দিনের যে কোনো সময় তা করা যায়। আর এই ইতিকাফকেই নফল ইতিকাফ বলে।

মহিলাদের ইতিকাফ

পুরুষ যেমনভাবে মসজিদে ইতিকাফ করবে তেমনি মহিলারাও তাদের নিজ নিজ গৃহে ইতিকাফ করবে। নারীদের জন্য ইতিকাফ জায়েজ ও বৈধ। তবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা যেমন অবাধে মসজিদে ইতিকাফ করতেন, বর্তমান সময়ে ফেতনার আশঙ্কায় তা জায়েজ নয়। বরং মহিলারা ঘরে নিজ কক্ষে ইতিকাফ করবে।

ইতিকাফের শর্ত

ইতিকাফের শর্ত ৩টি। যথা-

১. যে কোনো মসজিদে নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা হয়, এরূপ কোনো মসজিদে পুরুষদের অবস্থান করতে হবে। মহিলারা আপন ঘরে পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করবে।

২. ইতিকাফের নিয়তে ইতিকাফ করতে হবে। বিনা নিয়তে ইতিকাফ হয় না।

৩. ইতিকাফকারীকে সর্বদা পাক-পবিত্র থাকতে হবে।

ইতিকাফের নিয়ত : ইতিকাফের জন্য মসজিদে প্রবেশের সময় নিয়ত করে নিতে হয়।

ইতিকাফে করণীয়

ইতিকাফ অবস্থায় করণীয় হচ্ছে-

১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা,

২. নফল নামাজ আদায় করা,

৩. কুরআন তেলাওয়াত করা,

৪. দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও

৫. ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করা।

ইতিকাফে বর্জনীয়

ইতিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ বর্জনীয়-

১. ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদের বাইরে যাওয়া,

২. দুনিয়াবি আলোচনায় মগ্ন হওয়া,

৩. কোনো জিনিস বেচাকেনা করা,

৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ করা,

৫. ওজরবশত বাইরে গিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলম্ব করা ও

৬. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা। এসব কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়।

একটি ভুল আমল

কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, রমযানের শেষ দশ দিনে এলাকাবাসী কেউ ইতিকাফ না করলে অন্য এলাকা থেকে বা নিজ এলাকা থেকে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার ও পারিশ্রমিক দিয়ে ইতিকাফ করানো হয়। এ কাজটি ঠিক নয়। পারিশ্রমিকের মাধ্যমে ইতিকাফ করালে ইতিকাফ সহীহ হয় না।

ইতিকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই ইতিকাফের জন্য বিনিময় নেওয়াও জায়েয নেই। ফলে কাউকে বিনিময় দিয়ে ইতিকাফ করালে ইতিকাফ সহীহ হবে না এবং এর দ্বারা এলাকাবাসী দায়মুক্ত হতে পারবে না।

সমাপনী

পবিত্রতার জন্যই রোজা ও ইতিকাফ। পরিচ্ছন্নতা জন্য এর প্রয়োজন এবং জীবনকে একটি বলিষ্ঠ শৃঙ্খলার মধ্যে আনয়ন করাই এর উদ্দেশ্য। আত্মশুদ্ধি লাভ করে মানুষ যেন উন্নততর মহত্তর চারিত্রিক গুণাবলি অধিকারী হতে পারে, সংযম অভ্যাস করে মহান রাব্বুল আলামিনের বিধি-নিষেধ পালনে অভ্যস্ত হতে পারে, সবার উপরে এ জীবন সাধনার মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হতে পারে, এ জন্যই রোজা ও ইতিকাফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, এই পবিত্র রমজানে সিয়াম সাধনা ও ইতিকাফের মাধ্যমে সে লাভ করবে নতুন ঈমান, নতুন প্রাণ, অফুরন্ত কল্যাণ। লাভ করতে পারবে হাজার রজনীর চেয়ে উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর।

পিডিএফ ডাউনলোড