সেনানায়ক মুহাম্মাদ (সাঃ) | জুমুয়ার খুতবা


সেনানায়ক মুহাম্মাদ (সাঃ)
সেনানায়ক মুহাম্মাদ (সাঃ)

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম, যাতে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর রাসূল (সাঃ) এর জীবন ইসলামের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। এমনকি মহানবী (সাঃ) এর সামরিক জীবন ও গোটা মুসলিম জাতির জন্য এক অনন্য সামরিক জ্ঞানের উৎস। তার প্রতিরক্ষা কলাকৌশল, সামরিক গতিবিধি এবং চরম আক্রমণের ও প্রতিঘাতের নীতি কত শ্রেষ্ঠ ও উন্নত ছিল তা বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ সমর কৌশলীদেরও বিস্ময়াভূত করে। রাসূলে কারীম (সাঃ) এর অন্যান্য কাজ কর্মের ন্যায় তিনি যে একজন সেনা নায়ক ছিলেন তাও আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস।

সেনা নায়ক হিসেবে তার গুণাবলী

মহানবী (সাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ সেনানায়ক। তিনি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মিলিয়ে ৮০ টির বেশি যুদ্ধ পরিচালনা করলেও কখনো কোন যুদ্ধে পরাজিত হননি। আবার এমন ভাবে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন যাতে উভয়পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। তার মধ্যে অসাধারণ কিছু গুণাবলী সহ একজন সেনাপতির মধ্যে যতগুলো গুণাবলী থাকা দরকার তার সবগুলোই উপস্থিত ছিল।

ক) আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলে অবিচল

কোরআন মাজিদের সূরা আল ইমরান এর ১৫৯-১৬০  নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার উপরে ভরসা করার তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) এত বেশি তাওয়াক্কুল করতেন যে, প্রস্তুতি যাই থাকুক না কেন যুদ্ধ জয়ের জন্য আল্লাহর ওপর অবিচল ভাবে আস্থা রাখতেন। একবার হুনাইন সফরকালে আওতাস নামক স্থানে রাসুল (সাঃ) একটি বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈকঃ বেদুইন রাসুল (সাঃ) এর তলোয়ার হাতে নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললঃ এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় ও দৃঢ় কণ্ঠে বললেনঃ আল্লাহ! একথা শুনা মাত্রই তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। এর মধ্যে আবু বুরাইদা (রাঃ) তাকে হত্যা করতে চাইলেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাকে কোনরূপ তিরস্কার না করে মুক্তি দিয়ে দিলেন।  

(বুখারী - জিহাদ অধ্যায়)

খ) সাহসিকতা

পূর্বোক্ত ঘটনা থেকে যেমন মহানবী (সাঃ) এর সাহসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনি তার বীরত্ব ও সাহসিকতার আরো অনেক ঘটনা আছে। বেশ কয়েকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হুনাইনের যুদ্ধে যখন হাওয়াজিনের তীরন্দাজদের তীর বর্ষণে সবাই আত্মরক্ষার্থে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন তিনি অল্প কিছু সাহাবী নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং অন্যদের সাহস যোগাতে বলছিলেন

انا النبي لا كذب انا ابن عبد المطلب

আমি অবশ্যই নবী, এ কথা মিথ্যা নয়। আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান (বংশধর)।

বুখারী- কিতাবুত তাফসীর (সূরা তাওবা আয়াত ২৫-২৭; মুসলিম- জিহাদ ওয়াসিয়ার, সফর অভিযান অধ্যায়।)

উল্লেখ্য রাসুলের (সাঃ) সাহসিকতার কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং মুসলমানদের জয় হয়।

গ) দৃষ্টান্ত স্থাপন

রাসুল (সাঃ) তার সৈনিকদেরকে শুধু উপদেশ দিয়ে বসে থাকতেন না, নিজে উপস্থিত থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। তিনি ছোট-বড় ২৭ টি যুদ্ধে সরাসরি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাহাবীদের সাথে সকল কাজে অংশগ্রহণ করতেন। খন্দকের যুদ্ধে তিনি সাহাবীদের সাথে পরিখা খননের মাটি কেটেছেন। যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় সাড়ে তিন মাইল।

ঘ) বিচক্ষণতা

রাসুল (সাঃ) একজন বিচক্ষণ সেনানায়ক ছিলেন। যুদ্ধ পরিচালনা, যাতায়াতে অতিব গোপনীয়তা, ব্যাতিক্রম পথে যাতায়াত, সৈন্য দাঁড়ানো ও আক্রমণের উপযুক্ত স্থান নির্বাচন, শত্রুদের গতিবিধি ও তাদের সংখ্যা জানা এবং আক্রমণের অসাধারণ কৌশল অবলম্বন করে তিনি শত্রুদের মোকাবেলা করতেন।  

ঙ) মহানুভবতা

একজন সেনানায়ক কত বেশি মহানুভব হতে পারে তার দৃষ্টান্ত রাসুল (সাঃ)। যে মক্কাবাসী তাকে অল্প কিছুদিন আগে মক্কা ত্যাগে বাধ্য করেছে সে মক্কায় আজ বিজয়ের বেশে প্রবেশ করে প্রতিশোধ নিলেন না। বরং তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বললেন

لا تثريب عليكم اليوم

আজ তোমাদের উপর কোন অভিযোগ নেই।

চ) অধিনস্থদের প্রতি দয়া প্রদর্শন

এটি তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَلَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَاسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَشَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ

আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন।

(সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯)

রাসুলের সমর নীতি

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সমর নীতির মূল উৎ হচ্ছে আল কোরআন। পৃথিবীতে মানব গোষ্ঠীর মধ্যে সাধারণত যেসব কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হয় ইসলাম সেসব কারণে যুদ্ধের অনুমতি দেয় না। ইসলাম যুদ্ধের অনুমতি দেয় কেবলমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

এজন্য সাধারণ যুদ্ধ এবং আল-কুরআনের নির্দেশিত যুদ্ধনীতি এক নয়। রাসুল এর সমর নীতি ছিল নিম্নরূপঃ

ক) যুদ্ধের পূর্বে তিনটি শর্ত পেশ করা

  ১। ইসলাম কবুল করো। করলে তার উপর হাত উঠাবে না।

  ২। ইসলাম গ্রহণ না করলে জিজিয়া দিয়ে আনুগত্য স্বীকার করবে।

  ৩। এই দুটি শর্ত না মানলে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানাবে।

খ) প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা যাবেনা

রাসূল করীম (সাঃ) এর সমর নীতি ছিল চুক্তি বা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা যাবে না। যেমন হুদায়বিয়ার সন্ধি রক্ষায় তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

کَیۡفَ یَکُوۡنُ لِلۡمُشۡرِکِیۡنَ عَہۡدٌ عِنۡدَ اللّٰہِ وَعِنۡدَ رَسُوۡلِہٖۤ اِلَّا الَّذِیۡنَ عٰہَدۡتُّمۡ عِنۡدَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ۚ فَمَا اسۡتَقَامُوۡا لَکُمۡ فَاسۡتَقِیۡمُوۡا لَہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَّقِیۡنَ

মুশরিকদের চুক্তি আল্লাহর নিকট ও তাঁর রসূলের নিকট কিরূপে বলবৎ থাকবে। তবে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি সম্পাদন করেছ মসজিদুল-হারামের নিকট। অতএব, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের জন্যে সরল থাকে, তোমরাও তাদের জন্য সরল থাক। নিঃসন্দেহের আল্লাহ সাবধানীদের পছন্দ করেন।

(সূরা তাওবাহ ৯:৭)

গ) আশ্রয় চাইলে আশ্রয় দিতে হবে

রাসুল (সাঃ) এর যুদ্ধনীতিতে আছে কেউ আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَاِنۡ اَحَدٌ مِّنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ اسۡتَجَارَکَ فَاَجِرۡہُ حَتّٰی یَسۡمَعَ کَلٰمَ اللّٰہِ ثُمَّ اَبۡلِغۡہُ مَاۡمَنَہٗ ؕ  ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَعۡلَمُوۡنَ

আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছে দেবে। এটি এজন্যে যে এরা জ্ঞান রাখে না।

(সূরা তাওবাহ ৯:৬)

ঘ) সন্ধি করতে চাইলে সন্ধি করতে হবে

কোন যোদ্ধা যদি যুদ্ধক্ষেত্রে সন্ধি করতে চায় তবে তার সাথে সন্ধি করতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَاِنۡ جَنَحُوۡا لِلسَّلۡمِ فَاجۡنَحۡ لَہَا وَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত।

(সূরা আনফাল ৮:৬১)

ঙ) প্রতিশোধ গ্রহণে বাড়াবাড়ি করা যাবেনা

ইসলাম ক্ষমার নীতিতে বিশ্বাসী তবে প্রয়োজনে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَاِنۡ عَاقَبۡتُمۡ فَعَاقِبُوۡا بِمِثۡلِ مَا عُوۡقِبۡتُمۡ بِہٖ ؕ وَلَئِنۡ صَبَرۡتُمۡ لَہُوَ خَیۡرٌ لِّلصّٰبِرِیۡنَ

আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।

(সূরা নাহল ১৬:১২৬)

চ) নিরস্ত্রকে হত্যা করা যাবেনা

নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা করা যাবে না। যেমন হাদীসে এসেছে,

عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ وُجِدَتْ امْرَأَةٌ مَقْتُوْلَةً فِيْ بَعْضِ مَغَازِيْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَنَهَى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ قَتْلِ النِّسَاءِ وَالصِّبْيَانِ

ইব্‌নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন এক যুদ্ধে জনৈকা মহিলাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলা ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন।

(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩০১৫)

ছ) যুদ্ধ বন্ধীদের সাথে সৌজন্য মূলক আচরণ করা

বদর যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবারা বন্দিদের সাথে অতি উত্তম আচরণ করেছিলেন। তাই তো আল্লাহ বলেন,

وَیُطۡعِمُوۡنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّہٖ مِسۡکِیۡنًا وَّیَتِیۡمًا وَّاَسِیۡرًا

তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।

(সূরা আদ-দাহর ৭৬:৮)

জ) যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খেয়ানত না করা

যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ খেয়ানত করতে রাসুল নিষেধ করেছেন,

وَمَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّغُلَّ ؕ وَمَنۡ یَّغۡلُلۡ یَاۡتِ بِمَا غَلَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

আর কোন বিষয় গোপন করে রাখা নবীর কাজ নয়। আর যে লোক গোপন করবে সে কিয়ামতের দিন সেই গোপন বস্তু নিয়ে আসবে। অতঃপর পরিপূর্ণভাবে পাবে প্রত্যেকে, যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না।

(সূরা আলে ইমরান ৩:১৬১)

শানে নুজুলঃ বদর যুদ্ধে গনিমতের একখানা লাল চাদর হারানো গেলে একজন মুনাফিক রাসুল (সাঃ) এর নামে মিথ্যা অপবাদ দিলে এই আয়াত নাজিল হয়।

ঝ) আত্মসমর্পণ কারীর  বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়

যুদ্ধে যারা আত্মসমর্পণ করে তাদেরকে হেফাজত করার দায়িত্ব বিজয়ী দলের। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর আত্মসমর্পণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাসুল (সাঃ) নিষেধ করেছেন। বরং যে ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে।

ঞ) ধর্মযাজক ও উপসনালয় ধ্বংস করা যাবে না

রাসুলের (সাঃ) যুদ্ধনীতিতে রয়েছে অন্য ধর্মের ধর্মযাজক ও উপসনালয় ধ্বংস করা যাবে না।

ট) লাশ বিকৃত করা যাবে না

যুদ্ধে নিহত শত্রুপক্ষের কোন লাশ বিকৃত করা যাবে না। কেননা যুদ্ধে যে ব্যক্তি নিহত হয় তার সাথে প্রতিপক্ষের কোন শত্রুতা নেই।

ঠ) ফসল ধ্বংস করা যাবে না

রাসূল সাল্লাহু আলাই সাল্লাম ফলবান বৃক্ষ কাটতে, শস্যখেত জ্বালাতে, বসত বাড়ি কিংবা পশু পাল ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন।

রাসুলের (সাঃ) এর রণকৌশল 

রণকৌশল বলতে আমরা অনেক সময় বুঝে থাকি যুদ্ধের মাঠে বা যুদ্ধকালীন সময়ে কলা কৌশল অবলম্বন করাকে। প্রকৃতপক্ষে রণকৌশল বলতে এমন এক মহাপরিকল্পনাকে বুঝায় যা এক বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বহু পূর্ব হতে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য আল কুরআনে যুদ্ধ বিদ্যার জন্য শ্রেষ্ঠ কৌশল বর্ণনা করেছে। আর মহানবী (সাঃ) কুরআনের সেই কৌশল কে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন কিভাবে যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় আবার শত্রু মিত্র উভয় পক্ষেই হতাহত-ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। নিম্নে সেসব রণকৌশল উপস্থাপন করা হলোঃ

ক) প্রতিরক্ষা কেন্দ্র নির্বাচন

রাসূলে কারীম (সাঃ) হিজরতের মাধ্যমে মদিনাকে একটি প্রতিরক্ষা কেন্দ্র রূপে গড়ে তুলেছিলেন। কেননা প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তার সবগুলো মদিনা ছিল। যেমন,

  (১) মদিনা ছিল গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কের পাশে।

  (২) মদিনায় পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ছিল।

  (৩) মদিনায় খাদ্যদ্রব্যের সুব্যবস্থা ছিল।

খ) হারাম শরীফ ঘোষণা

মদিনা শহর কে রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে একে হারাম শরীফ ঘোষণা করা হয়েছে। যার অনুকরণে পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বায়তুল মুকাদ্দাস কে এবং বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটি কে হারাম (যুদ্ধ নিষিদ্ধ এলাকা) ঘোষণা করা হয়েছে।

গ) সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ

প্রশিক্ষণই সেনাবাহিনীর সর্বোত্তম কল্যাণ। মহান আল্লাহ প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেন,

وَاَعِدُّوۡا لَہُمۡ مَّا اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ قُوَّۃٍ وَّمِنۡ رِّبَاطِ الۡخَیۡلِ تُرۡہِبُوۡنَ بِہٖ عَدُوَّ اللّٰہِ وَعَدُوَّکُمۡ وَاٰخَرِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ ۚ لَا تَعۡلَمُوۡنَہُمۡ ۚ اَللّٰہُ یَعۡلَمُہُمۡ ؕ وَمَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ یُوَفَّ اِلَیۡکُمۡ وَاَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ

আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না।

(সূরা আনফাল ৮:৬০)

ঘ) শৃঙ্খলা ও আনুগত্য

শৃঙ্খলা ও আনুগত্য সেনাবাহিনীর মূল শক্তি। তাই মহানবী (সাঃ) শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দান করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সাঃ) বলেছেন,

عَنْ يَحْيَى بْنِ حُصَيْنٍ، قَالَ سَمِعْتُ جَدَّتِي، تُحَدِّثُ أَنَّهَا سَمِعَتِ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَخْطُبُ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ وَهُوَ يَقُولُ " وَلَوِ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا " .

ইয়াহ্‌ইয়া ইবনু হুসায়ন (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমি আমার দাদী থেকে শুনেছি, তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিদায় হাজ্জের ভাষণ দেয়ার সময় তাঁকে বলতে শুনেছেন যদি তোমাদের উপর একজন গোলামকেও কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালনা করে, তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মেনে চলবে।

(ই.ফা. ৪৬০৬, ই.সে. ৪৬০৮) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৬৫২

عَنْ شُعْبَةَ، بِهَذَا الإِسْنَادِ وَقَالَ عَبْدًا حَبَشِيًّا .

শুবাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ রিওয়ায়াতে হাবশী গোলাম শব্দটি আছে। 

(ই.ফা. ৪৬০৭, ই.সে. ৪৬০৯) সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৬৫৩

ঙ) পরামর্শ

রাসুল এর যুদ্ধ কৌশল ছিল পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَلَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَاسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَشَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ

আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন।

(সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯)

চ) উৎসাহ প্রদান

যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে গেলে মুমিনদেরকে যুদ্ধে উৎসাহ প্রদান করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ حَرِّضِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ عَلَی الۡقِتَالِ ؕ اِنۡ یَّکُنۡ مِّنۡکُمۡ عِشۡرُوۡنَ صٰبِرُوۡنَ یَغۡلِبُوۡا مِائَتَیۡنِ ۚ وَاِنۡ یَّکُنۡ مِّنۡکُمۡ مِّائَۃٌ یَّغۡلِبُوۡۤا اَلۡفًا مِّنَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاَنَّہُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَفۡقَہُوۡنَ

হে নবী, আপনি মুসলমানগণকে উৎসাহিত করুন জেহাদের জন্য। তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন দৃঢ়পদ ব্যক্তি থাকে, তবে জয়ী হবে দুশর মোকাবেলায়। আর যদি তোমাদের মধ্যে থাকে একশ লোক, তবে জয়ী হবে হাজার কাফেরের উপর থেকে তার কারণ ওরা জ্ঞানহীন।

(সূরা আনফাল ৮:৬৫)

জ) যোগ্য নেতা নির্বাচন

যোগ্য নেতৃত্ব সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কোন অভিযানে সৈন্য প্রেরণ করলে যোগ্য দল প্রতি নির্বাচন করে দিতেন। যেমন, খাইবার যুদ্ধ হযরত আলী (রাঃ) এর হাতে নেতৃত্ব দান এবং মুতার যুদ্ধে পর পর তিন জনকে অধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করেন।

ঝ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা

রাসূল করীম শুধুমাত্র যুদ্ধপ্রস্তুতি উপরে নির্ভর করতেন না বরং প্রস্তুতির সাথে সাথে রাতভর জেগে আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে থাকবেন এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। বদর যুদ্ধের ময়দানে এভাবে দোয়া করেছিলেন,

مُحَمَّدُ بْنُ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ حَوْشَبٍ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ حَدَّثَنَا خَالِدٌ عَنْ عِكْرِمَةَ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ بَدْرٍ اللهُمَّ إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ اللهُمَّ إِنْ شِئْتَ لَمْ تُعْبَدْ فَأَخَذَ أَبُوْ بَكْرٍ بِيَدِهِ فَقَالَ حَسْبُكَ فَخَرَجَ وَهُوَ يَقُوْلُ {سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ}

ইব্‌নু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, বাদ্‌রের দিন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ্‌! আপনি যদি চান (কাফিররা জয়লাভ করুক) তাহলে আপনার ইবাদত আর হবে না। আবূ বকর (রাঃ) তাঁর হাত ধরে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। তখন রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আয়াত পড়তে পড়তে বের হলেনঃ শীঘ্রই দুশমনরা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে

(সূরা ক্বামার ৫৪/৪৫)। [২৯১৫] (আ.প্র. ৩৬৬২, ই.ফা. ৩৬৬৫) সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৯৫৩

শেষ কথা

মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী আমাদের সেনাবাহিনী। মহানবী(সাঃ) এর সমগ্র জীবন মানবজাতির জন্য আদর্শতার গৃহীত কৌশল ও নীতিমালা অবলম্বন করতে হবে। নতুবা শান্তির পরিবর্তে পৃথিবীতে অশান্তি বাড়বে।

ডাউনলোড

পিডিএফ | ওয়ার্ড ফাইল ডাউনলোড করতে এখানে ক্লি করুন