শিরক কি? ও এর কুফল |
আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে তাওহীদের বিশ্বাস দিয়েই পৃথিবীতে
পাঠিয়ে থাকেন। তাওহীদই হল ঈমান ও আমলের মূলভিত্তি। কিন্তু বনী আদমের চিরশত্রু
শয়তান তো সহজে ছেড়ে দেবার নয়। সে তার কূটকৌশল বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেয়
গোমরাহীর অন্যতম পথ শিরক। কারণ শিরকই ধ্বংস করে দিতে পারে বনী আদমের স্বপ্নসাধকে, খান খান করে দিতে পারে গগনচুম্বী আমলের প্রাসাদকে।
ভেজাল করে দিতে পারে তার ঈমানকে। শয়তান প্রতারকের মত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন কায়দায় বনী আদমের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
ঈমানকে শিরকের আবর্জনায় কলুষিত করে দেয়। অথচ সে জানে না যে, এর মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায় তার মহামূল্যবান আমল।
বিলীন হয়ে যায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত ঈমান।
শিরক কী
শিরক কী? এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণার জন্য প্রয়োজন এর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
জানা।
ক। শিরক শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো:
(১) অংশীদার করা
(২) ইবনে মানযুর বলেছেন: আশ-শিরকাতু ও আশ-শারকাতু
সমার্থবোধক দুটি শব্দ। যার অর্থ দু'শরীকের সংমিশ্রণ। শিরকু অর্থ শরীক করা, শরীক হওয়া। এর বহুবচন হলো আশরাক ও তরাকার্ড অর্থাৎ
অংশীদারগণ। আশরাকা বিল্লাহি অর্থ সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো, আল্লাহর রাজত্বে ও মালিকানায়: কাউকে তার অংশীদার
সাব্যস্ত করলো (নাউযুবিল্লাহি)।
(৩) আল-মুনজিদ নামক অভিধানে বলা হয়েছে 'আশরাকা কী আমরিহী' অর্থাৎ তার কাজে (অপর কাউকে) শরীক করে নিয়েছে।
(8) 'আশ শিরকু' শব্দটি আল-হিসসাতু (অংশ) অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন হাদীসে
বর্ণিত হয়েছে: “মান আতাকা গুরাকান লাহু ফী আবদিন" যে তার কোন ক্রীতদাসের অংশকে মুক্ত করে
দিল।
খ। শিরক শব্দের
পারিভাষিক অর্থ। শিরক শব্দের পারিভাষিক অর্থ নিম্নরূপঃ
(১) ড. ইব্রাহিম বরীকান শিরক এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসংগে বলেন:
(ক) গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যেও সমকক্ষ করা। সমকক্ষ
বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে। শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহ
অংশের সমান হতে পারে। অথবা আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে।
(খ) আল্লাহর পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে উপাস্য হিসেবে
গ্রহণ করা।
(২) কুরআন, সুন্নাহ ও অতীত
মনীষীগণের কথায় শিরক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা শিরকের দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে
থাকে। অতএব আকীদার পরিভাষায় শিরক হচ্ছে, আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্টও সীমাবদ্ধ কোন বিষয় আল্লাহ্ ছাড়া
অন্য কারো জন্য প্রয়োগ করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা যে সমস্ত কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, ইবাদত, আনুগত্য এবং নাম-গুণাবলীর মধ্য থেকে যা নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন, তাতে অন্য কাউকে অংশীদার করাই হচ্ছে শিরক।
(৩) শিরক হল আল্লাহর নিরঙ্কুশ প্রভূত্বে কারো অংশীদারিত্বের আকীদা পোষণ করা।
শিরক হলো তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাওহীদ হচ্ছে একত্ববাদ আর শিরক হচ্ছে
বহুত্ববাদ।
শিরক না করাই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম
শিরক না করাই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। নিন্মে পবিত্র কুরআন
ও হাদিসের কিছু বর্ণনার অবতারণা করা হলো।
ক।
প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন
وَاِذۡ اَخَذَ رَبُّکَ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اٰدَمَ مِنۡ ظُہُوۡرِہِمۡ
ذُرِّیَّتَہُمۡ وَاَشۡہَدَہُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ ۚ اَلَسۡتُ بِرَبِّکُمۡ ؕ
قَالُوۡا بَلٰی ۚۛ شَہِدۡنَا ۚۛ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اِنَّا
کُنَّا عَنۡ ہٰذَا غٰفِلِیۡنَ ۙ
আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্টদেশ থেকে বের করলেন
তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই ? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। (সূরা আরাফ ৭:১৭২)
খ।
বুখারী শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله
عليه وسلم " كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ
يُهَوِّدَانِهِ وَيُنَصِّرَانِهِ كَمَا تَنَاتَجُ الإِبِلُ مِنْ بَهِيمَةٍ
جَمْعَاءَ هَلْ تُحِسُّ مِنْ جَدْعَاءَ " . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ
أَفَرَأَيْتَ مَنْ يَمُوتُ وَهُوَ صَغِيرٌ قَالَ " اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا
كَانُوا عَامِلِينَ "
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
বলেছেনঃ প্রতিটি সন্তানই ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাদেরকে
ইয়াহুদী বা খৃস্টান বানায়। যেভাবে উট পূর্ণাঙ্গ পশুই জন্ম দেয়, তাতে তোমরা কোন কান কাটা দেখো কি? সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অপ্রাপ্ত বয়সে মারা যায় এমন শিশু
সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন, আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কিরূপ আমল করতো। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৭১৪)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দাগণকে আমি খাঁটি (তাওহীদবাদী) করে সৃষ্টি করেছি।
অতঃপর শয়তানেরা তাদেরকে তাদের ব্যাপারে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। আমি তাদের জন্য যা
হালাল করেছি তা হারাম করে দিয়েছি। আমি যে শিরক করার ব্যাপারে কোন দলিল অবতীর্ণ
করিনি, আমার সাথে সে শিরক করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ করেছে।
(সহীহ মুসলিম ২৮৬৫)
উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস থেকে এই কথাই প্রমাণিত হলো যে, মানুষের জন্ম হয় তাওহীদের উপর। ফলে তাওহিদী চেতনা
তার স্বভাবের সাথে মিশে আছে। তাই দেখা যায় একজন মুশরিক, এমনকি একজন নাস্তিক ও বিপদ মুহূর্তে, সংকটকালে একমাত্র শক্তিধর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে
ফিরে আসে, কায়মনে বাক্যে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَاِذَا
مَسَّ النَّاسَ ضُرٌّ دَعَوۡا رَبَّہُمۡ مُّنِیۡبِیۡنَ اِلَیۡہِ ثُمَّ اِذَاۤ
اَذَاقَہُمۡ مِّنۡہُ رَحۡمَۃً اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ بِرَبِّہِمۡ
یُشۡرِکُوۡنَ ۙ
মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন তারা তাদের পালনকর্তাকে আহবান করে তাঁরই অভিমুখী
হয়ে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে রহমতের স্বাদ আস্বাদন করান, তখন তাদের একদল তাদের পালনকর্তার সাথে শিরক করতে থাকে, (সূরা রুম ৩০:৩৩)
শিরকের সূচনা
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে ও
বিভিন্ন পর্যায়ে শিরকের সূচনা হয়। নিম্নে শিরক প্রচলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
করা হলো:
ক)
ক্বাওমে নূহ
দুনিয়ায় প্রথম শিরক শুরু হয় নূহ (আঃ) এর কওমের মধ্যে। আর
তা হয়েছিল সৎ ও বুযুর্গ লোকদের প্রতি তাদের অতিরিক্ত ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের
মধ্যদিয়ে। তার কওমকে নেককার লোকদের অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনের নসীহত করে শয়তান তাদেরকে
শিরকে লিপ্ত করেছিল। এ প্রসংগে পবিত্র কোরআনের সূরা নুহ এ আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন।
وَقَالُوۡا
لَا تَذَرُنَّ اٰلِہَتَکُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّلَا سُوَاعًا ۬ۙ وَّلَا
یَغُوۡثَ وَیَعُوۡقَ وَنَسۡرًا ۚ
তারা বলছেঃ তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং
ত্যাগ করো না ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে। (সূরা নূহ ৭১:২৩)
খ)
বনি ইসরাইলে শিরকের সূচনা
বনী ইসরাঈলে প্রথম গো-বৎস পূজার প্রচলন করে সামেরী । এ ঘটনাটি
আল্লাহ তা'আলা আল-কুরআনের সূরা ত্ব-হা এর ৮৫-৮৯ আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ
فَاِنَّا قَدۡ فَتَنَّا قَوۡمَکَ مِنۡۢ بَعۡدِکَ وَاَضَلَّہُمُ السَّامِرِیُّ
বললেনঃ আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং
সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। (সূরা তোহা ২০:৮৫)
فَرَجَعَ
مُوۡسٰۤی اِلٰی قَوۡمِہٖ غَضۡبَانَ اَسِفًا ۬ۚ قَالَ یٰقَوۡمِ اَلَمۡ یَعِدۡکُمۡ
رَبُّکُمۡ وَعۡدًا حَسَنًا ۬ؕ اَفَطَالَ عَلَیۡکُمُ الۡعَہۡدُ اَمۡ اَرَدۡتُّمۡ
اَنۡ یَّحِلَّ عَلَیۡکُمۡ غَضَبٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ فَاَخۡلَفۡتُمۡ مَّوۡعِدِیۡ
অতঃপর মূসা তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রদ্ধ ও
অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদেরকে একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি
দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল তোমাদের কাছে দীর্ঘ
হয়েছে, না তোমরা চেয়েছ যে, তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে? (সূরা তোহা ২০:৮৬)
قَالُوۡا
مَاۤ اَخۡلَفۡنَا مَوۡعِدَکَ بِمَلۡکِنَا وَلٰکِنَّا حُمِّلۡنَاۤ اَوۡزَارًا مِّنۡ
زِیۡنَۃِ الۡقَوۡمِ فَقَذَفۡنٰہَا فَکَذٰلِکَ اَلۡقَی السَّامِرِیُّ ۙ
তারা বললঃ আমরা তোমার সাথে কৃত ওয়াদা স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি; কিন্তু আমাদের উপর ফেরউনীদের অলংকারের বোঝা চাপিয়ে
দেয়া হয়েছিল। অতঃপর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি। এমনি ভাবে সামেরীও নিক্ষেপ করেছে।
(সূরা তোহা ২০:৮৭)
فَاَخۡرَجَ
لَہُمۡ عِجۡلًا جَسَدًا لَّہٗ خُوَارٌ فَقَالُوۡا ہٰذَاۤ اِلٰـہُکُمۡ وَاِلٰہُ
مُوۡسٰی ۬ فَنَسِیَ ؕ
অতঃপর সে তাদের জন্য তৈরী করে বের করল একটি গো-বৎস, একটা দেহ, যার মধ্যে গরুর শব্দ ছিল। তারা বললঃ এটা তোমাদের উপাস্য
এবং মূসার ও উপাস্য, অতঃপর মূসা ভুলে গেছে।
(সূরা তোহা ২০:৮৮)
اَفَلَا
یَرَوۡنَ اَلَّا یَرۡجِعُ اِلَیۡہِمۡ قَوۡلًا ۬ۙ وَّلَا یَمۡلِکُ لَہُمۡ ضَرًّا
وَّلَا نَفۡعًا
তারা কি দেখে না যে, এটা তাদের কোন কথার উত্তর দেয় না এবং তারে কোন ক্ষতি ও
উপকার করার ক্ষমতাও রাখে না? (সূরা তোহা ২০:৮৯)
গ) আরব ভূখণ্ডে মূর্তি
পূজার সূচনা
রাসূল (সাঃ) এর রিসালাতের প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে
খুযাআ গোত্র প্রধান আমর ইবনে লহাই এর মাধ্যমে আরব ভূখণ্ডে মূর্তি পূজা শুরু হয় (আল-ফাওযুল
কাবীর পৃষ্ঠা-৫)।
ঘ)
বনী ইসমাঈলের পাথর পূজার সূচনা।
ইসমাঈল (আঃ) মক্কায় লালিত পালিত হন। সেখানে
তিনি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু কালের আবর্তনে কয়েক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হলে তাদের
অনেকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যখনই তারা কোথাও যেত হারামের সম্মানে হারামের
একটি পাথর সাথে নিয়ে যেত। যেখানে তারা অবস্থান করত, সেখানে ঐ পাথর রাখতো এবং কাবার মত এটির তাওয়াফ
করত। তারা পাথরের উপাসনাও করত। পরবর্তী প্রজন্ম এসে দ্বীনে ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে পরিবর্তন
করে মূর্তি পূজা শুরু করে দিল (আসসীরাতুন নাবিয়্যি খন্ড-১ পৃষ্ঠা-৭২)।
শিরক
করার কারণ
শিরক করার অনেক কারণ রয়েছে, উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো
ক) আল্লাহ সম্পর্কে
সঠিক ধারনার অভাব
খ) অতিরিক্ত ভক্তি ও
আবেগ
গ) ওয়াসিলার ভুল
ব্যাখ্যা
ঘ) পূর্বপুরুষদের
অন্ধ অনুসরণ
ঙ) সাফায়াতের ভুল
ব্যাখ্যা
চ) অজ্ঞতা
শিরকের
প্রকারভেদ
শিরক প্রধানত চার প্রকার
ক) আশ শিরকু ফিযযাত:
আল্লাহর সাথে শিরক।
খ) আশ শিরকু
ফিররুবূবিয়্যাহ: আল্লাহর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতায় অন্য কাউকে অংশীদার বলে বিশ্বাস করা। আল্লাহর
কাজে অন্যকে শরিক করা।
গ) আশ শিরকু ফিল
উলুহিয়্যাহ: ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করার নাম হচ্ছে আশ শিরকু ফিল
উলুহিয়্যাহ। এটাকে শিরক ফিল উবুদিয়্যাহ বা শিরক ফিল ইবাদত ও বলা হয়।
ঘ) আশ শিরকু ফিল আসমা
ওয়াস সিফাত: আল্লাহর সত্তাগত নাম ও গুণবাচক নামের সাথে শিরক করা।
শিরকের
কুফল
ক)
বড় জুলুম
وَاِذۡ
قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِہٖ وَہُوَ یَعِظُہٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰہِ ؕؔ
اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ
যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বললঃ হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক
করা মহা অন্যায়। (সূরা লোকমান ৩১:১৩)
খ)
ক্ষমার অযোগ্য গুনাহ
اِنَّ
اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَیَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ
یَّشَآءُ ؕ وَمَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا
নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর
ভ্রান্তিতে পতিত হয়। (সূরা নিসা ৪:১১৬)
গ)
যাবতীয় নেক আমল কে ধ্বংস করে দেয়
وَلَقَدۡ
اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَاِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ
لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَلَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের পতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের
একজন হবেন। (সূরা যুমার ৩৯:৬৫)
ঘ) জান্নাত হারাম করে দেয়
اِنَّہٗ
مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدۡ حَرَّمَ اللّٰہُ عَلَیۡہِ الۡجَنَّۃَ وَمَاۡوٰىہُ
النَّارُ ؕ وَمَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ
নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার
বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা ৫:৭২)
ঙ)
শিরক ক্ষমা করা হবে না
اِنَّ
اللّٰہَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِہٖ وَیَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ
یَّشَآءُ ۚ وَمَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর
নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করল আল্লাহর সাথে, সে যেন অপবাদ আরোপ করল। (সূরা নিসা ৪:৪৮)
চ)
বড় কবিরা গুনাহ
قَالَ
عَبْدُ اللهِ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَيُّ الذَّنْبِ
أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ قَالَ أَنْ تَدْعُوَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ قَالَ
ثُمَّ أَيٌّ قَالَ ثُمَّ أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ
قَالَ ثُمَّ أَيٌّ قَالَ ثُمَّ أَنْ تُزَانِيَ بِحَلِيلَةِ جَارِكَ فَأَنْزَلَ
اللهُ عَزَّ وَجَلَّ تَصْدِيقَهَا {وَالَّذِينَ لاَ يَدْعُونَ مَعَ اللهِ إِلَهًا
آخَرَ وَلاَ يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلاَ
يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا} الْآيَةَ.
‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এক লোক বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে বড়
গুনাহ্ কোন্টি? তিনি বললেনঃ তুমি
আল্লাহ্র সঙ্গে কাউকে সমকক্ষ গণ্য কর অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লোকটি বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেনঃ তারপর হলো, তুমি তোমার সন্তানকে এ ভয়ে হত্যা কর যে, সে তোমার সঙ্গে খাদ্য খাবে। লোকটি বলল, তারপর কোন্টি? তিনি বললেনঃ তারপর হলো, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে যিনা কর। অত:পর আল্লাহ
এ কথার সত্যতায় অবতীর্ণ করলেনঃ “এবং তারা আল্লাহ্র সঙ্গে কোন ইলাহকে আহ্বান করে না, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন উপযুক্ত কারণ ছাড়া
তাকে হত্যা করে না এবং ব্যাভিচার করে না। যে এগুলো করে সে শাস্তি ভোগ করবে” (সূরা ফুরক্বান ২৫/৬৮)। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩৯৬) সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৮৬১
ছ)
শিরক হল অপবিত্রতা
یٰۤاَیُّہَا
الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ فَلَا یَقۡرَبُوا
الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِہِمۡ ہٰذَا ۚ وَاِنۡ خِفۡتُمۡ عَیۡلَۃً
فَسَوۡفَ یُغۡنِیۡکُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖۤ اِنۡ شَآءَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ
عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ
হে
ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল-হারামের
নিকট না আসে। আর যদি তোমরা দারিদ্রের আশংকা কর, তবে আল্লাহ চাইলে নিজ করুনায় ভবিষ্যতে তোমাদের অভাবমুক্ত
করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা ৯:২৮)
জ)
শিরক ধ্বংস ও বিপর্যয়ের কারণ
حُنَفَآءَ
لِلّٰہِ غَیۡرَ مُشۡرِکِیۡنَ بِہٖ ؕ وَمَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَکَاَنَّمَا
خَرَّ مِنَ السَّمَآءِ فَتَخۡطَفُہُ الطَّیۡرُ اَوۡ تَہۡوِیۡ بِہِ الرِّیۡحُ فِیۡ
مَکَانٍ سَحِیۡقٍ
আল্লাহর দিকে একনিষ্ট হয়ে, তাঁর সাথে শরীক না করে; এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা
বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। (সূরা হাজ্জ ২২:৩১)
ঝ) শিরক এক চরম ব্যর্থতা
وَیَوۡمَ
یَقُوۡلُ نَادُوۡا شُرَکَآءِیَ الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ فَدَعَوۡہُمۡ فَلَمۡ
یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَہُمۡ وَجَعَلۡنَا بَیۡنَہُمۡ مَّوۡبِقًا
যেদিন তিনি বলবেনঃ তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে
তাদেরকে ডাক। তারা তখন তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা এ আহবানে সাড়া দেবে না। আমি তাদের মধ্যস্থলে
রেখে দেব একটি মৃত্যু গহবর। (সূরা কাহাফ ১৮:৫২)
ঞ)
মুশরিকদের জন্য ক্ষমা চাওয়া যাবে না
مَا
کَانَ لِلنَّبِیِّ وَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا
لِلۡمُشۡرِکِیۡنَ وَلَوۡ کَانُوۡۤا اُولِیۡ قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ
لَہُمۡ اَنَّہُمۡ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ
নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে
তারা দোযখী। (সূরা তাওবা ৯:১১৩)
ট)
শিরক দ্বারা আল্লাহর হক নষ্ট হয়
عَنْ
مُعَاذٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كُنْتُ رِدْفَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم
عَلَى حِمَارٍ يُقَالُ لَهُ عُفَيْرٌ، فَقَالَ " يَا مُعَاذُ، هَلْ تَدْرِي
حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ ".
قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ " فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ
عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ
الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا
". فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَفَلاَ أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ قَالَ
" لاَ تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا ".
মু’আয (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, উফাইর নামক একটি গাধার পিঠে আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পেছনে আরোহী ছিলাম। তিনি
আমাকে বললেন, হে মু’আয, তুমি কি জান বান্দার উপর আল্লাহ্র হক কী? এবং আল্লাহ্র উপর বান্দার হক কী? আমি বললাম, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহ্র হক হলো, বান্দা তাঁর ‘ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহ্র
উপর বান্দার হক হলো, তাঁর ‘ইবাদাতে কাউকে শরীক
না করলে আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দিবেন না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি কি লোকদের এ সুসংবাদ দিব না? তিনি বললেন, তুমি তাদের সুসংবাদটি দিও না, তাহলে লোকেরা এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৮৫৬)
উপসংহার
শিরক মিশ্রিত ঈমান মানুষের স্বপ্নসাধ ধ্বংস করে দেয়, কষ্টের আমলগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসুলকে জানিয়ে দিয়েছেন, যদি তুমি শিরক কর, তবে তোমার পাহাড়সম আমলগুলো মূহুর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে
এবং চরম ক্ষতিগ্রস্থতায় নিপতিত হবে। তাই সকল নবী রাসুলের দাওয়াতের মূল কথা ছিল একটাই-
আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন
তা হল, "তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তা হলে তোমরা সফলকাম হবে"
অন্তর থেকে শিরকী ও কুফরী চিন্তা চেতনাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে অন্তরকে ইমানের উপযোগী করা। আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালা বলেন
لَاۤ
اِکۡرَاہَ فِی الدِّیۡنِ ۟ۙ قَدۡ تَّبَیَّنَ الرُّشۡدُ مِنَ الۡغَیِّ ۚ فَمَنۡ
یَّکۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَیُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ
الۡوُثۡقٰی ٭ لَا انۡفِصَامَ لَہَا ؕ وَاللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই।
নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর
আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। (সূরা বাকারা ২:২৫৬)
সুতরাং আমাদেরকে খাঁটি মুমিন হতে হলে শিরক থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে শিরক মুক্ত জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন।