স্বামী স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য |
পরিবারের স্বামী এবং স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক। স্বামীর প্রতি যেমন স্ত্রীর অধিকার
রয়েছে, তেমনি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর
অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল করিমে বলেন,
ہُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ
وَاَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّہُنَّ
তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।
(সূরা বাকারা ২:১৮৭)
আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন,
وَمِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ
لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَجَعَلَ بَیۡنَکُمۡ
مَّوَدَّۃً وَّرَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।
(সূরা রুম ৩০:২১)
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী স্ত্রীর অধিকার
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কে একে অন্যের পোশাক বা আবরণ হিসেবে উল্লেখ
করা হয়েছে। প্রিয় রাসুলে কারীম (সঃ) বলেন
“মু’মিনদের মধ্যে পূর্ণতর মু’মিন সে যার ব্যবহার ভালো, আর তোমাদের মধ্যে ভালো সে, যে তার স্ত্রীদের জন্য ভালো”
(তিরমিযী শরীফ, মেশকাত শরীফ)
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সূরাতুন নিসার ১৯ নং আয়াতে
বলেন, “সাবধান! স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর”।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى امْرَأَةٍ لاَ تَشْكُرُ لِزَوْجِهَا وَهِىَ لاَ تَسْتَغْنِى عَنْهُ.
‘‘আল্লাহ সেই রমণীর দিকে তাকিয়েও দেখেন না (দেখবেন
না) যে তার স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, অথচ
সে স্বামীর মুখাপেক্ষিনী।
(নাসাঈ, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮৯নং)
হিন্দু
ধর্মে
হিন্দু ধর্মে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামীর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীর সমান অধিকার রয়েছে। স্ত্রীর জীবন রক্ষায় স্বামীর প্রাণপণ চেষ্টা হিসেবে রাম সীতার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। হিন্দু ধর্মে বিশেষভাবে বলা হয়ে থাকে কোন স্বামী তার স্ত্রীকে রেখে একা বসবাস করবে না এমনকি পূজা ও দিবে না। সাংসারিক জীবন এবং ধর্ম-কর্ম একসাথেই পালন করতে হবে।
স্বামী-স্ত্রীর
আরো কিছু অধিকার
১) একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান
ও শ্রদ্ধা পোষণ করবে
বিশ্বাস সম্মান ও শ্রদ্ধা শব্দগুলো একে অন্যের সাথে নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত। বিশ্বাস এর ঘাটতি দেখা দিলে সেখানে সম্মান ও শ্রদ্ধা পরিপূর্ণ থাকে না। তাই যেকোনো সম্পর্কে এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন বিশ্বাস এবং সম্মান ছাড়া কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না। একই ছাদের নিচে দৈহিক বসবাস করলেও একটি ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধন না থাকলে সে সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
২) একে অন্যকে সময় দেয়া
সময় জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শত ব্যস্ততার মাঝেও একজন একজনকে সময় না দিলে দিনে দিনে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তির পরিবর্তে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও দুইজন দুই মেরুতে বসবাস করে থাকে। তার দাম্পত্য জীবনে সময় দেওয়া একজনের নিকট অন্যজনের অধিকার।
৩) একে অন্যের পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনকে
সম্মান করা
একজন স্বামী যেমনিভাবে তার স্ত্রীর পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন কে সম্মান করবে তেমনি ভাবে স্ত্রীর উচিত স্বামীর আত্মীয়-স্বজন পিতা-মাতাকে নিজের পিতা মাতা আত্মীয়-স্বজন মনে করা। কারণ বিয়ে মানেই দুটি মানুষের বন্ধন নয় দুটি সমাজের, দুটি পরিবারের বন্ধন।
৪) কথায় কথায় একে অন্যের দোষ তালাশ না করা
মানুষ হিসেবে কেউই দোষ-ত্রুটির উর্ধে নয়। তেমনি ভাবে সংসারে স্বামী এবং স্ত্রীর ছোট ছোট অনেক দোষ ত্রুটি দেখা দিলেই সে গুলোকে বড় করে দেখে একে অন্যকে আঘাত করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবন কল্পনা করা যায় না। তবে সংশোধনের উদ্দেশ্যে একে অন্যের দোষ ত্রুটি নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। অবশ্যই সেটা হবে সংশোধনের জন্য। তবে ক্ষমা করে দেওয়াটাই মহত্বের লক্ষণ।
৫) কেউ কারো অতীত নিয়ে খোটা না দেওয়া
প্রতিটি মানুষের জীবনেই অতীতের ছোটখাটো কিছু ভুল ত্রুটি থাকাটা অসম্ভব নয়। সে গুলোকে সামনে এনে একে অন্যকে আঘাত করা কোনভাবেই একটি দাম্পত্য জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে না। আবার যে অতীত-বর্তমান দাম্পত্য জীবনে কলহ বয়ে আনবে এমন অতীত নিয়ে নিজে পড়ে থাকা ও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
৬) একজন রাগ করলে আরেকজন চুপ থাকা
মানুষের একটি স্বভাবজাত আচরণ হলো রাগ করা। নানা কারণে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাগ আসতেই পারে। রাগ আসলেই রাগের বশে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আবার একজনের রাগ হলে অন্যজনের ধৈর্য ধারণ করা উচিত। না হয় তা দাম্পত্য জীবনের জন্য ভয়াবহ ফলাফল ডেকে আনতে বাধ্য।
স্বামীর
প্রতি বিশেষ কিছু দায়িত্ব
১) স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্যতম দায়িত্ব হলো বিয়ের পরপরই স্ত্রীর মোহরানা প্রদান
করা। সে মোহরানার মালিক এককভাবে স্ত্রী। মোহরানার টাকা দিয়ে স্ত্রী যদি কোটিপতি হয়
তবুও তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর। নারীদের মোহরানা বিষয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন
وآتوا النساء صدقاتهن نحلة فإن طبن لكم عن شيء منه نفسا
فكلوه هنيئا مريئا
আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে
অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে
ভোগ কর।
(আন নিসা - ৪:৪)
২) ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আরো একটি দায়িত্ব হলো স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা।
এ ভরণপোষণ ব্যবস্থা করতে গিয়ে কৃপণতা বা অপচয় করা যাবে না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে
হবে। হাদীসে এসেছে
عَنْ حَكِيمِ بْنِ مُعَاوِيَةَ
عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم مَا حَقُّ
الْمَرْأَةِ عَلَى الزَّوْجِ قَالَ أَنْ يُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمَ وَأَنْ
يَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَى وَلَا يَضْرِبْ الْوَجْهَ وَلَا يُقَبِّحْ وَلَا
يَهْجُرْ إِلَّا فِي الْبَيْتِ
মুআবিয়াহ (বিন হায়দার) (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস
করল, স্বামীর উপর স্ত্রীর কি অধিকার
রয়েছে? তিনি বলেন, সে আহার করলে তাকেও (একই মানের) আহার করাবে, সে পরিধান করলে তাকেও একই মানের পোষাক পরিধান করাবে (অথবা তোমাদের
ভরণপোষণের সাথে তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে এবং তোমাদের পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা
করার সাথে তাদের পোষাক-পরিচ্ছদের ও ব্যবস্থা করবে)। কখন ও তার মুখমণ্ডলে আঘাত করবে
না, অশ্লীল গালমন্দ করবে না এবং নিজ
বাড়ী ছাড়া অন্যত্র তাকে একাকী ত্যাগ করবে না।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৮৫০)
৩) পরিবারের জন্য খরচ করবে
স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততির জন্য সাধ্য অনুযায়ী সম্পদ ব্যয়
করা। পরিবারের জন্য খরচ করা এক ধরনের সদকা। হাদীসে এসেছে
آدَمُ بْنُ أَبِي إِيَاسٍ
حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ عَدِيِّ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ
يَزِيدَ الأَنْصَارِيَّ عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ الأَنْصَارِيِّ فَقُلْتُ عَنْ
النَّبِيِّ فَقَالَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا أَنْفَقَ الْمُسْلِمُ
نَفَقَةً عَلٰى أَهْلِه„ وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَه“ صَدَقَةً.
আবূ মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাবী বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ এটা কি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে? তিনি বললেন, (হ্যাঁ) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ সওয়াবের আশায় কোন মুসলিম যখন তার পরিবার-পরিজনের প্রতি ব্যয় করে, তা তার সদকা হিসাবে গণ্য হয়। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৩৫১)
৪) নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা
বিয়ের পর পর স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীর নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা। স্বামী-স্ত্রীর বসবাসের স্থান নিরাপদ না হলে নিরাপদ পরিবেশ দাম্পত্য জীবনের অশান্তির অন্যতম কারণ। এমনকি পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ সন্তানসন্ততির জন্য হুমকির কারণ।
স্ত্রীর
প্রতি বিশেষ কিছু দায়িত্ব
১) স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো স্ত্রী স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর
সম্পদের যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। কাউকে দান করতে হলেও স্বামীর অনুমতি নিতে হবে।
হাদীসে এসেছে
عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله
عنهما ـ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ "
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ
عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ،
وَالْمَرْأَةُ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا رَاعِيَةٌ وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا،
وَالْخَادِمُ فِي مَالِ سَيِّدِهِ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ".
قَالَ وَحَسِبْتُ أَنْ قَدْ قَالَ " وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي مَالِ أَبِيهِ
".
ইব্নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছি তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং তোমাদের প্রত্যেককেই
তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। শাসক হলেন দায়িত্ববান, তার দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের
দায়িত্ববান এবং তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের
সম্পদের দায়িত্ববান, তার সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা
হবে। গোলাম তার মালিকের ধন-সম্পদের দায়িত্ববান, তাকে
তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। রাবী বলেন, আমার
মনে হয় তিনি এও বলেছেন যে, পুত্র তার পিতার সম্পদের দায়িত্ববান।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৭৫১)
২) সতীত্ব সম্ভ্রম রক্ষা করা
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একটি অন্যতম কর্তব্য হলো স্ত্রী নিজের সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা করবে। চরিত্রহীন একটি দাম্পত্য জীবনে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু সেখানে সুখ শান্তি কল্পনা করা যায় না। নবী (সাঃ) বলেন,
إِذَا صَلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا، وَصَامَتْ شَهْرَهَا، وَحَصَّنَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا، دَخَلَتْ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ.
‘‘রমণী তার পাঁচ ওয়াক্তের নামায পড়লে, রমযানের রোযা পালন করলে, ইজ্জতের
হিফাযত করলে ও স্বামীর হুকুম মানলে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছামত প্রবেশ করতে
পারবে।
(মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৫৪)
৩) সন্তান লালন পালন
সন্তান লালন পালন স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব। তবে এ ক্ষেত্রে স্বামীকেও সমান দায়িত্ব
পালন করতে হবে। সন্তানকে সুশিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দু'জনকেই বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।