চন্দ্রগ্রহণ – সূর্যগ্রহণ এবং আমাদের করণীয়-বর্জনীয় "Lunar eclipse - solar eclipse" and our do's and don'ts | মুহাঃ আবুবকর ছিদ্দিক | Abubokar Siddik

"চন্দ্রগ্রহণ" এবং আমাদের করণীয়-বর্জনীয় "Lunar eclipse - solar eclipse" and our do's and don'ts
"চন্দ্রগ্রহণ  সূর্যগ্রহণ" এবং আমাদের করণীয়-বর্জনীয়

মহান আল্লাহর কুদরতের অনন্য নির্দশন ও সৃষ্টির মধ্যে চন্দ্র-সূর্য অন্যতম। প্রতিদিনই মানুষ চন্দ্র সূর্য দেখে থাকে। সময়ের ব্যবধানে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে। এই চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ আল্লাহ তাআলার কুদরতের দুটি অন্যতম নিদর্শন। এসব নিয়ে রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও করণীয়। কী সেসব করণীয় ও দিকনির্দেশনা?

সূর্যগ্রহণ কী?

চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোন দর্শকের কাছে সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায় (কিছু সময়ের জন্য)। এই ঘটনাকে সূর্যগ্রহণ বলা হয়।

চন্দ্র গ্রহণ কী?

চন্দ্রগ্রহণকে আরবিতে খুসুফ বলা হয়। গ্রহণ লাগলে সূর্য যেমন অন্ধকার ছায়ার আবর্তে পতিত হয়ে অন্ধকার হয়ে যায়, তেমনি চন্দ্রও বছরে দুইবার স্বীয় কক্ষপথে পরিভ্রমণরত অবস্থায় অন্ধকারের ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। ইহার আংশিক রূপ কখনো দৃশ্যমান হয়। আবার কখনো সার্বিক রূপ পরিদৃষ্ট হয়। চন্দ্রের এ কালো রঙ বা অন্ধকারের হাতছানিকেই চন্দ্রগ্রহণরূপে আখ্যায়িত করা হয়।

কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ - وَخَسَفَ الْقَمَرُ - وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ

যখন দৃষ্টি চমকে যাবে। চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে।

(সুরা কিয়ামাহ : আয়াত ৭-৯)

উল্লেখিত আয়াতে চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে পড়ার বাস্তব রূপই হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ।

চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে বিশ্বনবির নির্দেশনা

জাহেলি যুগে চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ছিল। তারা মনে করত দুনিয়ায় বড় বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকদের কোনো অঘটন ঘটলে এসব হয়। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে ইবরাহিম-এর মৃত্যুর দিনে সুর্যগ্রহণ হয়। তখন সাহাবায়ে কেরাম তা বলাবললি করছিল। তা শুনে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট বর্ণনা দেন। হাদিসে এসেছে-

> হজরত মুগিরা ইবনে শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آياتِ اللهِ، لاَ يَنْخَسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلاَ لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ ذلِكَ فَادْعُوا اللهَ وَكَبِّرُوا وَصَلُّوا وَتَصَدَّقُوا

সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন-

১. তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।

২. তাঁর মহত্ব ঘোষণা করবে আর

৩. নামাজ আদায় করবে এবং

৪. সাদকা প্রদান করবে। (বুখারি ও মুসলিম)

> হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ مِنْ آيَاتِ اللهِ، وَإِنَّهُمَا لَا يَنْخَسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ، وَلَا لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُمَا فَكَبِّرُوا، وَادْعُوا اللهَ وَصَلُّوا وَتَصَدَّقُوا،

সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর কুদর (ক্ষমতার) বিশেষ নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ হয় না। অতঃপর যখন তোমরা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ দেখতে পাও, তখন-

১. তাকবির (اَللهُ اَكْبَر) বল;

২. আল্লাহর কাছে দোয়া কর;

৩. নামাজ আদায় কর এবং

৪. দান-সদকা কর। (মুসলিম)

হাদিসের নির্দেশনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহ তাআলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। আর তাতে গ্রহণ লাগা আল্লাহ তাআলার হুকুমেই হয়। তাদের নিজস্ব কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তাআলার হুকুমের অধীনেই তাদের চলাচল এবং কার্যক্রম।

তাতে গ্রহণ লাগলে মুমিন মুসলমানের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং চন্দ্রগ্রহণের এ সময়ে বেশি বেশি দোয়া করা, তাসবিহ পড়া, তাওবাহ-ইসতেগফার করা, নামাজ পড়া এবং দান-সাদকার আবশ্যক কর্তব্য।

এ সময় অযথা অনর্থক গল্প-গুজব, হাসি-তামাশায় সময় অতিবাহিত না করে অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি ভয় রাখা জরুরি। কেননা এসবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সতর্কতা। অনেক হাদিসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণকে বিশেষ বিপদের সময় বা ক্রান্তিকাল বলে গণ্য করা হয়েছে।

চন্দ্রগ্রহণের নামাজ

হাদিসে পাকে সূর্যগ্রহণের নামাজের মতো চন্দ্রগ্রহণের নামাজও প্রমাণিত এবং সুন্নাত। তবে এ নামাজ জামাআতে ও একাকি পড়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে। হানাফি অনুসারীরা এ নামাজ একাকি নিজ নিজ ঘরে পড়ার ওপর তাগিদ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ বাদায়েউস সানাঈ-তে এসেছে-

ﺃَﻣَّﺎ ﻓِﻲ ﺧُﺴُﻮﻑِ ﺍﻟْﻘَﻤَﺮِ ﻓَﻴُﺼَﻠُّﻮﻥَ ﻓِﻲ ﻣَﻨَﺎﺯِﻟِﻬِﻢْ؛ ﻟِﺄَﻥَّ ﺍﻟﺴُّﻨَّﺔَ ﻓِﻴﻬَﺎ ﺃَﻥْ ﻳُﺼَﻠُّﻮﺍ ﻭُﺣْﺪَﺍﻧًﺎ

চন্দ্রগ্রহণের সময় ঘরে নামাজ আদায় করা হবে। কেননা সুন্নাহ হচ্ছে, তখন একাকি নামাজ পড়া। (বাদায়েউস সানাঈ : ১/২৮২)

চন্দ্রগ্রহণের সময় নারীদের করণীয়

নারীরাও চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময় ঘরে একাকি নামাজ আদায় করবেন। গ্রহণ চলাকালীন সময়ে জিকির-আজকার ও তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া এবং তাওবাহ-ইসতেগফারে নিয়োজিত থাকবেন।

কুসংস্কারে বিশ্বাস না করা জরুরি

চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ নিয়ে সমাজে ব্যাপক কুসংস্কার, বিভ্রান্তি ও অমূলক ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে গর্ভবর্তী ও কুমারী নারীদের ক্ষেত্রে এ কুসংস্কার অনেক বেশি। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারগুলো হলো-

১. এ সময় কোনো কিছু খেতে নেই। বলা হয়- চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে এবং সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা নিষেধ!

২. এ সময় তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হবে!

৩. এ সময় যৌন সম্ভোগ করা যাবে না!

৪. গর্ভবতী মায়েরা এ সময় যা করে, তার প্রভাব গর্ভের সন্তানের ওপর পড়বে!

৫. গ্রহণের সময় গর্ভবতী মায়েদের কাত হয়ে শোয়া নিষেধ; কারণ এভাবে শোয়ার ফলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়!

৬. চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপারে দুই ধরনের গপ্প শুনতে পাওয়া যায়। প্রথমত : শিশুটি অসুস্থ হবে এবং দ্বিতীয়ত : শিশুটি চালাক হবে!

৭. প্রসূতি মা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ দেখলে তার অনাগত সন্তানের বিকলঙ্গ হবে!

৮. চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়।

৯. এ সময় কোনো নারীকে ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করাও অন্যায়।

১০. চলা-ফেরায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ রকম অনেক কুসংস্কারমূলক কথা প্রচলিত রয়েছে। এ সবই কুসংস্কার ও ভুল বিশ্বাস। ইসলামের এ সবের কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং এ সবে বিশ্বাস করা ঈমানহীনতার শামিল।

মূল কথা হলো

চন্দ্র গ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময় কুমারী কিংবা গর্ভবতী মায়েদের ভয় কিংবা আশঙ্কার কিছু নেই। অন্যান্য দিনের মতো তারা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবে। তবে হাদিসে নির্দেশিত আমলে গ্রহণের সময় অতিবাহিত করাই হচ্ছে উত্তম।

মুমিন মুসলমানের উচিত, চন্দ্রগ্রহণের সময় হাদিসে ঘোষিত আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করা। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারে বিশ্বাস না করা। কেননা এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য ক্ষতিকারক।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে চন্দ্রগ্রহণের সময় দোয়া, তাসবিহ, তাওবাহ, ইসতেগয়ার, নামাজ ও দান-সাদকা করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সংকলিত

আরো পড়ুনঃ

শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ।

গর্ভবতীর উপর চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব। 

.

সূর্যগ্রহণ কি, সূর্যগ্রহণ কয় প্রকার ও কি কি, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ কাকে বলে, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ কেন হয়, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ পার্থক্য, চন্দ্রগ্রহণের সময় গর্ভবতী, চন্দ্রগ্রহণের সময় সহবাস করলে কি হয়, Lunar eclipse, lunar eclipse meaning, total lunar eclipse meaning, lunar eclipse meaning spiritual,  what does total lunar eclipse mean, solar eclipse and lunar eclipse, solar eclipse meaning, types of solar eclipse, 3 types of solar eclipse, 

.