রক্তদান Donate Blood

রক্তদান Donate Blood
রক্তদান

ভূমিকা  মানুষের জীবন রক্ষায় রক্তের কোনো বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার এ বিকল্পহীন একধরনের তরল যোজক কলা তৈরির মানব শরীর ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উৎসও নেই। ফলে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করতে হয় কোটি কোটি মানুষকে। বিশ্বে প্রতি বছর ১০ কোটি ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু প্রয়োজন অনেক বেশি।

রক্তের প্রয়োজনীয়তা

প্রয়োজনীয় রক্তের ৩৫-৪০ ভাগ পাওয়া যায় রোগীর নিকটজন থেকে, ১৫-২০ ভাগ স্বেচ্ছাসেবী থেকে ও ১৫-২০ ভাগ পেশাদার রক্ত বিক্রেতা থেকে। বাকি ২০-২৫ ভাগ বা প্রায় ২.৫ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থেকে যায়। অন্যদিকে পেশাদার বিক্রেতারা যে ১৫-২০ শতাংশ রক্তের যোগান দেন তা অনিরাপদ। ফলে ঘাটতি ও অনিরাপদ রক্তের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বা প্রায় ৫ লাখ।

বাংলাদেশ  ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের বছরে রক্ত লাগে প্রায় ৪ লাখ ব্যাগ৷ ২০১৯ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ব্যাগে৷ এই এক দশকেরও কম সময়ে দেখা যাচ্ছে রক্তের চাহিদা বেড়েছে ৩ গুনের বেশি৷দেশে রক্তের অভাবে বছরে ৫৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি দুই সেকেন্ডে একজনের রক্ত দরকার হয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় ৩৬০০০ ইউনিট লাল রক্তকণিকা প্রয়োজন প্রায় ৭০০০ ইউনিট প্লেটলেট এবং ১০০০০ ইউনিট প্লাজমা প্রয়োজন হয়।

রক্তদানের জন্য জনসচেতনতা  রক্তদানের বিষয়ে আমাদের অনেকের মাঝে ভীতি কাজ করে তাই এই ভীতি দূর করার জন্য আমাদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে আমাদের নিজেদের পরিবার থেকেই এই সচেতনতা শুরু করতে হবে মনে রাখতে হবে আজ আমি অন্যকে রক্ত দিতে ভয় পেলে অন্যদিন আমার রক্ত দরকার হবে কিভাবে অন্যের কাছে রক্তের জন্য যাব?

স্বেচ্ছায় রক্তদান  স্বেচ্ছায় নিজের রক্ত অন্য কারো প্রয়োজনে দান করাই রক্তদান তবে রক্তদাতাকে অবশ্যই পূর্ণবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হতে হয় প্রতি তিন মাস অন্তর প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে রক্তদান করতে পারেন এতে স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না তবে রক্তদানের পদ্ধতি ও পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অযথা    ভীতির কারণে অনেকেই রক্ত দিতে দ্বিধান্বিত হন কিন্তু রক্তদানেরও যে উপকারিতা রয়েছে

রক্তদানের উপকারিতা

)রক্তদানে কোনো সমস্যা হয় না কেননা একজন সুস্থ মানুষের শরীরে পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে এর মধ্যে সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত দান করা হয়, যা শরীরে থাকা মোট রক্তের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ রক্তের মূল উপাদান পানি, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পূরণ হয়

)রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বোনম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়, ঘাটতি পূরণ হয়

)বছরে তিনবার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলে ও নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়ায়

)নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার ভালো থাকে

৫) স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা খরচে করা হয় এর মাধ্যমে জানা যায় শরীরে অন্য বড় কোনো রোগ আছে কি না যেমনহেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি

৭) রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়তা করে

)রক্তে কোলস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে

)শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতিকে বলে Hemochromatosis নিয়মিত রক্তদান এই রোগ প্রতিরোধ করে

১০)স্থূলদেহী মানুষের ওজন কমাতে রক্তদান সহায়ক

১১) মুমূর্ষুকে রক্ত দিলে মানসিক তৃপ্তি মেলে

রক্তদানের শর্তগুলোঃ

) রক্তদাতাকে সুস্থ থাকতে হবে এবং ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪৫ কেজি ওজনের যেকোনো মানুষ রক্তদান করতে পারে

) দাতার রক্তের স্ক্রিনিং টেস্ট বা রক্ত নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা

) ভরপেটে খাওয়ার চার ঘণ্টা পর রক্ত দেওয়া শ্রেয়

) কোনো রূপ এনার্জি ড্রিংক রক্তদানের আগে সেবন না করাই ভালো

) যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তদান করতে পারেন

যাঁদের রক্তদান নিষেধ

) ক্যান্সার, হিমোফিলিয়া, ম্যালেরিয়াসহ জীবাণুঘটিত কোনো রোগী

) এইচআইভি বা এইডস আক্রান্তরা

) মাদক সেবনকারী

) হেপাটাইটিস-বি ও সি-র এন্টিজেন পজিটিভ যাঁদের পরবর্তী সময় তা নেগেটিভ হলেও রক্ত দেওয়া যাবে না

) গর্ভবতী মহিলারা

) যাঁদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হয়

) যাঁরা বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন

)গত তিন মাসের মধ্যে রক্তদান করেছেন এমন মানুষ

১০) যাঁদের শরীরের কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড (লিম্ফনোড) ফুলে গেছে বিশেষ করে ঘাড়, গলায়, হাতের নিচের গ্লান্ড

কে রক্তদান করতে পারে?

) একজন রক্তদাতা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা জরুরি যেমন:

) আপনার বয়স অবশ্যই ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হতে হবে

)আপনার ওজন কমপক্ষে ৫০ কেজি হতে হবে

) রক্তদানের সময় আপনার শরীর অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে

) নিয়মিত রক্তদানের ক্ষেত্রে আপনাকে একবার রক্ত দেয়ার পর কমপক্ষে ৮ থেকে ১৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে পুনরায় রক্তদানের জন্য

) আপনি যদি সর্দি, গলা ব্যথা, পেট ব্যথা বা অন্য কোনো সংক্রমণে ভুগে থাকেন তাহলে রক্তদান করতে পারবেন না

) আপনি যদি দাঁতের ছোট কোনো চিকিৎসা করে থাকেন তবে কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা এবং দাঁতের বড় ধরনের চিকিৎসা নিয়ে থাকলে রক্ত দেয়ার আগে কমপক্ষে এক মাস অপেক্ষা করুন

) রক্তদানের জন্য আপনার রক্তে অবশ্যই ন্যূনতম হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ থাকতে হবে যেটি নারীদের জন্য ১২ গ্রাম/ডিএল এবং পুরুষদের জন্য ১৩ গ্রাম/ডিএল

) আপনার যদি পরীক্ষায় কখনো এইচআইভি (এইডস ভাইরাস) শনাক্ত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই রক্ত দেয়া থেকে বিরত থাকুন

১০) আপনি যদি ইনজেকশনের মাধ্যমে কোনো মাদক গ্রহণ করে থাকেন তাহলে রক্তদান থেকে বিরত থাকুন

১১) সম্প্রতি ম্যালেরিয়া প্রবণ কোনো এলাকা ভ্রমণ করে থাকলে রক্তদান থেকে বিরত থাকুন

কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা কি রক্ত দান করতে পারবে?

যখন কোনো ব্যক্তি কোভিড-১৯ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন তার রক্তের প্লাজমাতে প্রোটিন অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যা নতুন করোনভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে যারা করোনা পুরোপুরি নিরাময় পেয়েছেন এবং সুস্থ হওয়ার কমপক্ষে দুই সপ্তাহ পরও যাদের মধ্যে নতুন করে করোনা সংক্রমণের লক্ষণ নেই, তাদেরকে রক্তের তরল অংশ বা প্লাজমা দানে উৎসাহিত করা হয় তবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্লাজমা থেরাপি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে

রক্ত দেয়ার পরে আপনার শরীরে কী ঘটে?

হার্ট অ্যাটাক এবং লিভারের বিভিন্ন অসুখের ঝুঁকি হ্রাস করে:  আয়রন ওভারলোডকে হৃৎপিণ্ড, লিভার, অন্ত:স্রাব গ্রন্থি এবং সারা শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন জমে থাকার বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় ২০১৩ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেশি হলে হৃদরোগ এবং লিভারের অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি থাকে নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে আপনি নিজের শরীরের অতিরিক্ত আয়রন প্রতিরোধ করতে পারেন এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে আপনার হৃদরোগ এবং লিভারের অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাস পাবে

ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো ক্যান্সার রক্তদান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করতে পারে যদি আপনি আপনার শরীরের আয়রনের স্তরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে লিভার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার এবং অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে

নতুন রক্তকণিকা তৈরি রক্তদানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হবে নতুন রক্তকণিকা আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে

অকালবার্ধক্যের ঝুঁকি কমায়  রক্তদানের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করা আপনাকে স্বর্গীয় মানসিক শান্তি এবং তৃপ্তি প্রদান করবে এটি আপনাকে মানসিক চাপ মুক্ত করতে সহায়তা করবে, যা অন্যতম প্রধান কারণ এছাড়া রক্ত দেয়ার পর শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয় যা অকালে ত্বক কুঁচকে যাওয়া কমায়

কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়  কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান করলে কোলেস্টেরল, লিপিড এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হ্রাস পায় এছাড়া রক্তকণিকাগুলো আয়রন দিয়ে তৈরি হয়, যা অতিরিক্ত হলে রক্তনালীগুলোর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে নিয়মিত রক্তদান করার মাধ্যমে আপনি অতিরিক্ত আয়রন প্রতিরোধ করতে এবং কোলেস্টেরল বজায় রাখতে পারেন

বিশ্ব কেন আরও স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার প্রয়োজন?

সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায় এবং ২-৫ কোটি মানুষ আহত হন বা অক্ষম হয়ে পড়েন এই হতাহতের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘটে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে আর অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪ লাখ ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়

এছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এসব শিশুর নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান রক্ত উৎপদদন করতে সক্ষম হয়নি তাই রক্ত পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো দান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করা দান করা রক্ত ভবিষ্যত প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ব্লাড ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা হয়

রক্তদান জীবন বাঁচাতে পারে আপনি যখনই রক্তদান করছেন, তখন আপনি অন্তত তিন জনের জীবন বাঁচাতে অবদান রাখছেন

রক্তদানের কি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে?

সুস্বাস্থের অধিকারী প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য রক্তদানের ক্ষেত্রে কোনো ক্ষতি নেই প্রত্যেক রক্তদাতার জন্য নতুন/জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক সুতরাং রক্তদানের ক্ষেত্রে দাতার কোনো ঝুঁকি নেই। 
যদিও রক্তদানের পর আপনার বমিভাব বা মাথা ঘোরা অনুভব হতে পারে তবে এ লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েক মিনিটের জন্য স্থায়ী হয় এটি হলে আপনি সুস্থ বোধ না করা পর্যন্ত পা সোজা করে শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারেন