আখলাকে হামিদাহ বা প্রশংসনীয় চরিত্র | জুমুয়ার খুতবা

আখলাক্বে হামিদা বা প্রশংসনীয় আচরণ

আখলাক্বে হামিদা বা প্রশংসনীয় আচরণ

আখলাক বা চরিত্র মানুষের আসল চিত্র। মানুষের মূল্যায়ন হয় চরিত্রে। চারিত্রিক মূল্যবোধ যার যত বেশি সে তত উন্নত। এজন্য ইসলামে বিশেষ করে আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় চরিত্রের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। এমনকি ইহাই দ্বীন ইসলামের মূল কথা। মহানবী (সাঃ) এ পৃথিবীতে আগমনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবিক চরিত্রের সংশোধন। হাদীস শরীফে এসেছে,

عن أبي هريرة: إنّما بعثتُ لأتمِّمَ مَكارِمَ الأخلاقِ.

নিশ্চয় মহান আল্লাহ আমাকে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীকে পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। (মিশকাত ৫৭৭০)

আখলাকে হামিদা

আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় চরিত্র বলতে মানুষের মানবিক সুকুমার বৃত্তির বিকাশ বা মৌলিক মানবীয় গুণাবলী কে বুঝায়। যা মানব সমাজের সভ্যতা ও শান্তির জন্য একান্ত প্রয়োজন। নিম্নে সে প্রশংসনীয় মানবীয় চারিত্রিক গুণাবলী গুলো আলোচনা করা হলোঃ

ক) তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি

মানুষের মাঝে তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতির বিকাশ হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। কেননা আল্লাহ ভীরু মানুষ কোন অন্যায় করতে পারে না। প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তার সামনে উপস্থিত থাকেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ اَتۡقٰکُمۡ

নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। (আল হুজরাত ৪৯:১৩)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَاَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল ইমরান ৩:১০২)

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدَبٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ الْحَسَبُ الْمَالُ وَالْكَرَمُ التَّقْوَى ‏"‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ مِنْ حَدِيثِ سَمُرَةَ ‏.‏ لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ مِنْ حَدِيثِ سَلاَّمِ بْنِ أَبِي مُطِيعٍ وَهُوَ ثِقَةٌ ‏.‏

সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ধন-সম্পদ হল আভিজাত্যের প্রতীক এবং পরহেজগারী হল সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। (জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩২৭১)

খ) সততা ও সত্যবাদিতা

সততা ও সত্যবাদিতা নিজের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে। সত্যবাদী ও সৎ মানুষের সমাজ হয় শান্তিপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَقُوۡلُوۡا قَوۡلًا سَدِیۡدًا ۙ یُّصۡلِحۡ لَکُمۡ اَعۡمَالَکُمۡ وَیَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَمَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا

হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। (আল আহ্‌যাব ৩৩:৭০-৭১)

وَعَنِ ابنِ مَسعُودٍ رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى البِرِّ، وَإِنَّ البِرَّ يَهْدِي إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقاً . وَإِنَّ الكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الفُجُورِ، وَإِنَّ الفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّاباً». متفقٌ عَلَيْهِ

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পথ নির্দেশনা করে। আর মানুষ সত্য কথা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে মহাসত্যবাদী রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদিতা নির্লজ্জতা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে মহামিথ্যাবাদী রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। (রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৫৫০)

ফুটনোটঃ (সহীহুল বুখারী ৬০৯৪, মুসলিম ২৬০৬, ২৬০৭, তিরমিযী ১৯৭১, আবূ দাউদ ৪৯৮৯, ইবনু মাজাহ ৪৬, আহমাদ ৩৫৩১, ৩৭১৯, ৩৮৩৫, ৩৮৮৬, ৪০১২, ৪০৮৪, ৪০৯৭, ৪১৭৬, মুওয়াত্তা মালিক ১৮৫৯, দারেমী ২৭১৫)

গ) মানুষকে কষ্ট না দেয়া

সব মানুষই এক আল্লাহর বান্দা এবং আদম (আঃ) এর সন্তান। কেউ কাউকে কষ্ট দেবে না এটাই ইসলামের অভিপ্রায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو ـ رضى الله عنهما ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللَّهُ عَنْهُ ‏"‏‏.‏

আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌নু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, সে-ই মুসলিম, যার জিহবা ও হাত হতে সকল মুসলিম নিরাপদ এবং সে-ই প্রকৃত মুহাজির, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে ত্যাগ করে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৯, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৯, মুসলিম ১/১৪ হাঃ ৪০, আহমাদ ৬৭৬৫)

ঘ) ধৈর্যধারণ করা

ধৈর্য মানুষের একটি মহৎ গুণ। ধৈর্যধারণকারীরা ধৈর্যধারণের মাধ্যমে সার্বিক কল্যাণ লাভ করেন। মহান আল্লাহ তাআলা ধৈর্যধারণ সম্পর্কে বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَالصَّلٰوۃِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ

হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (আল বাকারা ২:১৫৩)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اصۡبِرُوۡا وَصَابِرُوۡا وَرَابِطُوۡا ۟  وَاتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার। (আল ইমরান ৩:২০০)

ঙ) ক্ষমা ও উদারতা

ক্ষমা ও উদারতা এমন একটি মহৎ গুণ যার দ্বারা মানুষের মনের রাজ্য জয় করা যায়। মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয় করে চরম শত্রুদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিলেন,

قَالَ لَا تَثۡرِیۡبَ عَلَیۡکُمُ الۡیَوۡمَ ؕ یَغۡفِرُ اللّٰہُ لَکُمۡ ۫ وَہُوَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ

বললেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের কে ক্ষমা করুন। তিনি সব মেহেরবানদের চাইতে অধিক মেহেরবান। (ইউসুফ ১২:৯২)

চ) বিনয় ও নম্রতা

বিনয় ও নম্রতা মানুষকে মানবতার উচ্চতম শিখরে পৌঁছে দেয়। আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ হতে শেখায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَلَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَاسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَشَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ

আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। (আল ইমরান ৩:১৫৯)

বান্দার গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ ہَوۡنًا وَّاِذَا خَاطَبَہُمُ الۡجٰہِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا

রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম। (আল ফুরকান ২৫:৬৩)

ছ) আমানতদারিতা

আমানতদারি মমিন জীবনের অন্যতম প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণ। মানুষের মাঝে বিশ্বাসী ও ভালোবাসার পাত্র হবার এবং মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার উত্তম পন্থা হচ্ছে আমানতদারীতা। আমানতদারীতার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

اِنَّ اللّٰہَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَہۡلِہَا ۙ

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। (আন নিসা ৪:৫৮)

সুরা মুমিনুনের অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالَّذِیۡنَ ہُمۡ لِاَمٰنٰتِہِمۡ وَعَہۡدِہِمۡ رٰعُوۡنَ ۙ

এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে। (আল মুমিনূন ২৩:৮)

আমানতদারিতা সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَلَّمَا خَطَبَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِلاَّ قَالَ لاَ إِيْمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِيْنَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ.

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে এরূপ উপদেশ খুব কমই দিয়েছেন, যাতে একথাগুলি বলেননি যে, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই এবং যার অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দ্বীন-ধর্ম নেই।'

(ঊপদেশ, হাদিস নং ১৭, আহমাদ হা/১১৯৩৫, মিশকাত হা/৩৫, বাংলা মিশকাত হা/৩১)

জ) অঙ্গীকার পূর্ণ করা

অঙ্গীকার পূর্ণ করা সৎ চরিত্রবান লোকদের একটি উত্তম গুন। আল্লাহ নিজেই অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

وَلَا تَقۡرَبُوۡا مَالَ الۡیَتِیۡمِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ حَتّٰی یَبۡلُغَ اَشُدَّہٗ ۪ وَاَوۡفُوۡا بِالۡعَہۡدِ ۚ اِنَّ الۡعَہۡدَ کَانَ مَسۡـُٔوۡلًا

আর, এতিমের মালের কাছেও যেয়ো না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাংখা ছাড়া; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যৌবনে পদার্পন করা পর্যন্ত এবং অঙ্গীকার পূর্ন কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (বনী-ইসরাঈল ১৭:৩৪)

ঝ) লজ্জাশীলতা

লজ্জাশীলতা ঈমানের অংশ ও আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার লজ্জা নেই সে যা খুশি তাই করতে পারে, হাদীস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي مَسْعُودٍ، قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النُّبُوَّةِ إِذَا لَمْ تَسْتَحِي فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ ‏"‏‏

আবূ মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী‎ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, প্রথম যুগের আম্বিয়া-এ-কিরামের উক্তিসমূহ যা মানব জাতি লাভ করেছে, তন্মধ্যে একটি হল, যদি তোমার লজ্জা না থাকে, তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই কর।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৪৮৪)

লজ্জা কি ঈমানের শাখা হিসেবে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ঈমানের ষাটেরও অধিক শাখা আছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা।

(মুসলিম ১/১২ হাঃ ৩৫, আহমাদ ৯৩৭২, সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ৮, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৮)

ঞ) দানশীলতা

মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, ভালবাসা, অনুগ্রহ এবং অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা উত্তম মানবিক গুণ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَنۡ تَنَالُوا الۡبِرَّ حَتّٰی تُنۡفِقُوۡا مِمَّا تُحِبُّوۡنَ ۬ؕ وَمَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فَاِنَّ اللّٰہَ بِہٖ عَلِیۡمٌ

কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন। (আল ইমরান ৩:৯২)

ট) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার দান ও অনুগ্রহের শেষ নেই। তাই সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য। এছাড়া মানুষ যার দ্বারা উপকৃত ও অনুগ্রহিত হয় তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একটি মহৎ ব্যক্তিত্বের ব্যাপার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আল্লাহ তাআলা খুশি হন, আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکُمۡ لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ وَلَئِنۡ کَفَرۡتُمۡ اِنَّ عَذَابِیۡ لَشَدِیۡدٌ

যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইব্রাহীম ১৪:৭)

ঠ) ন্যায় বিচার

উত্তম চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ন্যায়বিচার করা। এই গুনটি হলো মানব চরিত্রের সকল গুণের সমষ্টি। ন্যায় বিচার করতে পারলেই সমাজে আর কোন অশান্তি থাকে না। কেননা ন্যায় বিচার হবে নিজের প্রতি, পরিবার, সমাজ ও জাতির প্রতি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُہَدَآءَ لِلّٰہِ وَلَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَوِ الۡوَالِدَیۡنِ وَالۡاَقۡرَبِیۡنَ ۚ اِنۡ یَّکُنۡ غَنِیًّا اَوۡ فَقِیۡرًا فَاللّٰہُ اَوۡلٰی بِہِمَا ۟ فَلَا تَتَّبِعُوا الۡہَوٰۤی اَنۡ تَعۡدِلُوۡا ۚ وَاِنۡ تَلۡوٗۤا اَوۡ تُعۡرِضُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا

হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত। (আন নিসা ৪:১৩৫)

আখলাকে হামিদা এর গুরুত্ব

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে

When money is lost nothing is lost, health is lost something is lost but character is lost everything is lost.

আর ইসলামের প্রশংসনীয় চরিত্র হচ্ছে সর্বোত্তম সম্পদ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

صِبۡغَۃَ اللّٰہِ ۚ وَمَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ صِبۡغَۃً ۫ وَّنَحۡنُ لَہٗ عٰبِدُوۡنَ

আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রং এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?আমরা তাঁরই এবাদত করি। (আল বাকারা ২:১৩৮)

হাদীস শরীফে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا ‏"‏

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে ঈমানে পরিপূর্ণ মুসলমান হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। যেসব লোক নিজেদের স্ত্রীদের নিকট উত্তম তারাই তোমাদের মধ্যে অতি উত্তম। (হাসান সহীহ্, সহীহা ২৮৪, জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১১৬২)

আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় চরিত্র অর্জনের উপায়

সৎ চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কোন কিছু নেই। তাই এ গুণ অর্জন করা প্রতিটি মানুষের একান্ত প্রয়োজন। নিম্নোক্তভাবে আমরা এগুণ অর্জন করতে পারি,

ক) আল কুরআনের শিক্ষা

আল-কুরআন ইসলামী শরীয়তের প্রধান উৎস। এতে মানব জীবনের সকল বিষয়ে পূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কোরআনের যাবতীয় আহকাম পালনের মাধ্যমে একজন মানুষ উত্তম ও প্রশংসনীয় চরিত্রের অধিকারী হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اِنَّ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَہۡدِیۡ لِلَّتِیۡ ہِیَ اَقۡوَمُ وَیُبَشِّرُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ اَجۡرًا کَبِیۡرًا ۙ

এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে। (বনী-ইসরাঈল ১৭:৯)

খ) বিশ্ব নবীর আদর্শ গ্রহণ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহ, আদর্শ ও হাদিস অনুসরণের মাধ্যমে এ মহৎ চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্রের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

وَاِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ

আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (আল ক্বলম ৬৭:৪)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَالۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ؕ

যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (আল আহ্‌যাব ৩৩:২১)

গ) আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে

মানুষের শরীরের একটি অংশ আত্মা তা কলুষিত হলে গোটা দেহই কলুষিত হয়ে যায়। আর এটি পরিশুদ্ধ হলে গোটা দেহই পরিশুদ্ধ হয়। সুতরাং আত্মার পরিশুদ্ধি উত্তম চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ تَزَکّٰی ۙ

নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়। (আল আ'লা ৮৭:১৪)

ঘ) শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে

অসৎপ্রবনণ ব্যক্তিদের নসিহতের মাধ্যমে সংশোধন করা না গেলে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কঠোরতা আরোপ করে, প্রয়োজনে শাস্তি প্রয়োগ করে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নৈতিকতা ও উত্তম চারিত্রিক মূল্যবোধের দিকে ফিরিয়ে আনা যায়। আল্লাহ তাআলার নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী ও শাসকদের চারটি প্রধান কাজের কথা উল্লেখ করে বলেন,

اَلَّذِیۡنَ اِنۡ مَّکَّنّٰہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَاَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَنَہَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَلِلّٰہِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ

তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি- সামর্থবান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত। (আল হাজ্জ্ব ২২:৪১)

সমাপনী

ইসলামে আখলাক বা চারিত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অনেক বেশি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আখলাকে হামিদা প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন আমীন।

খুতবা পিডিএফ ডাউনলোড লিংক

লিংক ১ | লিংক ২

আলোচনা পিডিএফ ডাউনলোড লিংক

লিংক ১ | লিংক ২