ইমাম নাসাঈ (রহঃ) এর জীবনী | Biography of Imam Nasai (RA)

ইমাম নাসাঈ (রহঃ)
ভূমিকা : ইমাম  নাসাঈ (রহঃ) ইলমে হাদীছের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি সুনানে নাসাঈ সহ অনেক  মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করে মুসলিম বিশ্বে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। সততা, বিশ্বস্ততা,  আমানতদারিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহভীরুতায় তিনি ছিলেন অনন্য। হাদীছ চর্চায় তিনি  নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।


নাম ও পরিচিতি : ইমাম নাসাঈ-এর প্রকৃত নাম আহমাদ, পিতার নাম শো‘আইব। উপাধি اَلْاِمَامُ الْحَافِظُ (আল-ইমামুল হাফেয), اَلْحَافِظُ الْحُجَّةُ (আল-হাফেযুল হুজ্জাহ), উপনাম আবু  আব্দুর রহমান, নিসবতী নাম  আল-খোরাসানী, আন-নাসাঈ। ‘নাসা’-এর দিকে  সম্বন্ধিত করে তাঁকে নাসাঈ বলা হ’ত। ‘নাসা’ খোরাসানের একটি প্রসিদ্ধ শহর। আরবের  লোকেরা কখনো কখনো এটাকে ‘নাসাবী’ (النَّسَوِي) বলে থাকে। কিয়াস হিসাবে উচ্চারণ এভাবেই হওয়া  উচিত। তবে নাসাঈ উচ্চারণটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর পুরো বংশপরিক্রমা  হ’ল- আবু আব্দুর রহমান আহমাদ ইবনু শো‘আইব ইবনে আলী ইবনে সিনান ইবনে বাহার  আল-খোরাসানী আন-নাসাঈ।
কোন কোন ঐতিহাসিক  ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর বংশপরিক্রমায় আহমাদ ইবনু শো‘আইব ইবনে আলী-এর পরিবর্তে আহমাদ  ইবনু আলী ইবনে শো‘আইব উল্লেখ করেছেন। এ দু’টো বর্ণনার  মধ্যে সমন্বয় সাধন এভাবে করা যায় যে, দাদার প্রসিদ্ধি ও পরিচিতির কারণে পুত্রের  সম্পর্ক কখনো কখনো দাদার প্রতি আরোপ করা হ’ত।
জন্ম : ইমাম নাসাঈ (রহঃ)  ২১৫ হিজরী মুতাবিক ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে মতান্তরে ২১৪  হিজরীতে খোরাসানের ‘নাসা’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এ স্থানের দিকে  সম্বন্ধিত করে তাঁকে আন-নাসাঈ বলা হয়। এ নামেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
আল্লামা ইবনুল আছীর ও জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) বলেন, তিনি ২২৫ হিজরীতে  জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ইবনু মানযূর, আল-মিযযী ও আল্লামা যাহাবী (রহঃ) বলেন,انه ولد عام ২১৫هـ وهو الراجح، ‘তিনি ২১৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। এটিই প্রাধান্যযোগ্য  অভিমত’।
শিক্ষা জীবন : ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর সময়ে খোরাসান ও তার পার্শ্ববর্তী  এলাকা সমূহ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইলমে হাদীছের কেন্দ্রভূমি হিসাবে পরিচিত ছিল। সেখানে  অনেক খ্যাতনামা বিদ্বানের সমাবেশ ঘটেছিল। ইমাম নাসাঈ (রহঃ) স্বীয় জন্মভূমিতেই  প্রখ্যাত আলেমগণের তত্ত্ববধানে পড়া-লেখা শুরু করেন। পনের বছর বয়স পর্যন্ত তিনি স্বদেশেই কুরআন মাজীদ হিফয ও প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন  করেন।
দেশ ভ্রমণ : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা  সমাপনের পর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে ইলমে হাদীছে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি ২৩০ হিজরী  মুতাবিক ৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে  তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন দেশ ও জনপদের খ্যাতিমান মনীষীদের দরজায় কড়া নাড়েন।
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) নিজেই বলেছেন, رحلتي  الأولى إلى قتيبة كانت في سنة ثلاثين ومائتين أقمت عنده سنة وشهرين ‘আমি ২৩০  হিজরীতে সর্বপ্রথম কুতায়বা ইবনু সাঈদের নিকট গমন করি এবং তাঁর সান্নিধ্যে এক বছর  দু’মাস অবস্থান করি’। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র পনের বছর।
শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘তিনি অনেক বড় বড় শায়খের  সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি খুরাসান, হিজায, ইরাক, জাযীরা, শাম, মিশর প্রভৃতি শহরে  পরিভ্রমণ করেন’।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,رَحَلَ إِلَى الْآفَاقِ،  وَاشْتَغَلَ بِسَمَاعِ الْحَدِيْثِ وَالِاجْتِمَاعِ بِالْأَئِمَّةِ الْحُذَّاقِ، وَمَشَايِخُهُ  الَّذِيْنَ رَوَى عَنْهُمْ مُشَافَهَةً. ‘তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং অভিজ্ঞ ইমামগণের নিকট থেকে  হাদীছ শ্রবণে মনোনিবেশ করেন। আর যাদের নিকট থেকে তিনি মুখে মুখে হাদীছ বর্ণনা  করেছেন, তাঁদের নিকট থেকেও হাদীছ শ্রবণ করেন। আল্লামা ইউসুফ  আল-মিযযী ‘তাহযীবুল কালাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, طاف البلاد وسمع بخراسان والعراق والحجاز ومصر والشام والجزيرة من جماعة ‘তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং খোরাসান,  ইরাক, হিজায, মিসর ও জাযীরার একদল মুহাদ্দিছের নিকট থেকে হাদীছ শ্রবণ করেছেন’।
ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি  খোরাসান, হিজায, মিসর, ইরাক, জাযীরা, সিরিয়া এবং সীমান্ত এলাকায় ভ্রমণ করেন। অতঃপর  মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন’।
শিক্ষকমন্ডলী : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) স্বদেশে হুমাইদ ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২৪৪ হিঃ), আম্মার ইবনুল  হাসান (মৃঃ ২৪২ হিঃ) প্রমুখ খ্যাতিমান শায়খের নিকট শৈশবকালে শিক্ষার্জন করেন।
ড. তাকীউদ্দীন নদভী স্বীয় ‘আ‘লামুল মুহাদ্দিছীন’ গ্রন্থে  লিখেছেন,  ‘তিনি অসংখ্য মনীষী থেকে হাদীছ  শ্রবণ করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম বিদেশে পরিভ্রমণ করে কুতাইবা ইবনু সাঈদ (মৃঃ ২৪০  হিঃ)-এর নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকের মধ্যে রয়েছেন  ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ (ইমাম বুখারী (রহঃ)-এরও উস্তায), মুহাম্মাদ ইবনু নযর, আলী  ইবনু হাজার, ইউনুস ইবনু আব্দুল আলা, মুহাম্মাদ বিন বাশার, ইমাম আবূ দাঊদ  সিজিস্তানী প্রমুখ। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ইমাম বুখারী (রহঃ)-কেও ইমাম নাসাঈ  (রহঃ)-এর শিক্ষক হিসাবে গণ্য করেছেন। অনুরূপভাবে আবু যুর‘আ ও আবু হাতিম আর-রাযী  থেকেও তার হাদীছ বর্ণনা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে আরো রয়েছেন, বিশর  ইবনে হেলাল, আল-হাসান ইবনুস সাববাহ আল-বাযযার, আম্মার ইবনে খালেদ আল-ওয়াসিতী,  ইমরান ইবনে মূসা আল-কাযযায প্রমুখ।
সুনানে কুবরাতে ইমাম নাসাঈ (রহঃ) ৪০৩ জন শিক্ষকের নিকট থেকে এবং সুনানে  ছুগরা তথা সুনানে নাসাঈতে ৩৩৫ জন শায়খের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনু  আসাকিরের বর্ণনা মতে তাঁর শিক্ষকের সংখ্যা ৪৪৪ জন।
ছাত্রবৃন্দ : দেশ-বিদেশে  উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর ইমাম নাসাঈ (রহঃ) হাদীছের দরস প্রদান শুরু করেন। অনেক  শিক্ষার্থী তাঁর নিকট থেকে ইলমে হাদীছ শিক্ষা লাভ করেছে।
আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘মিসরে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু  করেন এবং সেখানে তাঁর রচনাবলী প্রসার লাভ করে। বহু জ্ঞান পিপাসু তাঁর নিকট থেকে  জ্ঞান আহরণ করেছেন। অতঃপর তিনি দামেশকে চলে যান’।
তাঁর ছাত্রদের  মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হ’লেন- ‘আমালুল ইয়াওম ওয়াল লায়লাহ’ গ্রন্থের খ্যাতিমান  লেখক ইবনুস সুন্নী, আহমাদ ইবনুল হাসান আর-রাযী, আবুল হাসান আহমাদ আর-রামলী, আবু  জা‘ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আন-নাহবী, আবু সাঈদ আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুল আরাবী,  আবু জা‘ফর আহমাদ আত-তাহাবী প্রমুখ।
সুনানু নাসাঈ  সংকলন : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) প্রথমে ‘আস-সুনানুল কুবরা’ নামে একটি বৃহৎ হাদীছগ্রন্থ  সংকলন করেন। যাতে ছহীহ ও যঈফ হাদীছের সংমিশ্রণ ছিল। এ সম্পর্কে আল্লামা আবু যাহূ বলেন,  ‘ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বিশুদ্ধ ও ত্রুটিযুক্ত হাদীছ সম্বলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’ গ্রন্থ  প্রণয়ন করেন। অতঃপর একে
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বলেন,لما عزمت على جمع كتاب السنن استخرت الله تعالى في الرواية عن شيوخ كان في  القلب منهم بعض الشيء فوقعت الخيرة على تركهم فنزلت في جملة من الحديث كنت أعلو فيه عنهم- ‘যখন আমি সুনানে নাসাঈ সংকলন করতে  দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হ’লাম, তখন কিছু শায়খ থেকে হাদীছ বর্ণনা করার ব্যাপারে আমার অন্তরে  খটকা সৃষ্টি হ’লে আমি আল্লাহর দরবারে ইস্তেখারা করলাম। অতঃপর তাদের হাদীছ  পরিত্যাগের বিষয়ে কল্যাণকর ইঙ্গিত পেলাম। ফলে আমি তাতে এমন কিছু হাদীছ সন্নিবেশিত  করিনি, যেগুলো তাদের নিকট থেকে আমার নিকট উচ্চতর সনদে পৌঁছেছিল’।
সাইয়িদ  জামালুদ্দীন বলেন, ‘ইমাম নাসাঈ (রহঃ) প্রথমে ‘আস-সুনানুল কাবীর’ নামক একটি গ্রন্থ  সংকলন করেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। হাদীছের বিভিন্ন সূত্র সংবলিত এমন  গ্রন্থ আর কেউ রচনা করতে সক্ষম হয়নি’।
ইবনুল আছীর বলেন, ফিলিস্তীনের রামাল্লার আমীর ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস  করলেন, আপনার সংকলিত ‘আস-সুনানুল কুবরা’-তে সন্নিবেশিত সকল হাদীছই কি ছহীহ? উত্তরে  তিনি বললেন, না। এতে ছহীহ ও যঈফ মিশ্রিত আছে। তখন আমীর তাঁকে বললেন, এ গ্রন্থ থেকে  শুধু ছহীহ হাদীছগুলো চয়ন করে আমাদের জন্য একটি বিশুদ্ধ হাদীছগ্রন্থ সংকলন করুন। এ  প্রেক্ষিতে তিনি আস-সুনানুল কুবরার যে সকল হাদীছের সনদে ত্রুটি আছে বলে অভিযোগ  ছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে ‘সুনানুল মুজতাবা’ সংকলন করেন’।
ড. তাকীউদ্দীন নাদভী লিখেছেন, উপরোক্ত কাহিনী আল্লামা ইবনুল আছীর স্বীয়  ‘জামিউল উছূল’ গ্রন্থে এবং মোল্লা আলী ক্বারী মিশকাতের ভাষ্যগ্রন্থ ‘মিরক্বাত’-এ  উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আল্লামা যাহাবী বলেছেন, উপরোক্ত বর্ণনা সঠিক নয়; বরং সুনানে  কুবরাকে সংক্ষেপ করে ‘মুজতাবা’ সংকলন করেছেন ইমাম নাসাঈর সুযোগ্য ছাত্র ইবনুস  সুন্নী।
আল্লামা ইবনু আসাকির বর্ণনা করেছেন, এ গ্রন্থটির নাম اَلْمُجْتَنَى অথবা اَلْمُجْتَبَى উভয়টিই সমার্থক শব্দ। তবে শেষোক্ত اَلْمُجْتَبَى শব্দটিই অধিক প্রসিদ্ধ। যখন কোন মুহাদ্দিছ  হাদীছ বর্ণনা শেষে বলবেন, اِنَّ النَّسَائِىَّ رَوَى حَدِيْثًا ‘ইমাম নাসাঈ (রহঃ) হাদীছটি স্বীয় কিতাবে  বর্ণনা করেছেন, তখন এটা দ্বারা ‘সুনানুল মুজতাবা’কেই বুঝাবে, সুনানুল কুবরাকে নয়। উল্লেখ্য, এটিই ‘সুনানে নাসাঈ’ নামে পরিচিত। ‘মুজতাবা’ শব্দের অর্থ হ’ল  বাছাইকৃত চয়নকৃত, নির্বাচিত এবং ‘মুজতানা’ শব্দের অর্থ হ’ল সংগৃহীত বা আহরিত ফল।
সুনানে নাসাঈর হাদীছ ও অধ্যায় সংখ্যা : ইবনুল  আছীরের মতে, সুনানে নাসাঈতে সংকলিত হাদীছ সংখ্যা ৪৪৮২টি।[38] শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানীর গণনা অনুযায়ী নাসাঈর মোট হাদীছ সংখ্যা ৫৭৫৮। এতে মোট একান্নটি কিতাব (অধ্যায়) রয়েছে।
সুনান  গ্রন্থসমূহের মধ্যে আলোচ্য বিষয় এবং হাদীছের দিক দিয়ে সুনানে নাসাঈ বিশদ ও ব্যাপক। ইমাম নাসাঈ  (রহঃ) এ গ্রন্থ সংকলনে ইমাম বুখারী (রহঃ) ও ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর রীতি অনুসরণ  করেছেন এবং তাঁদের উভয়ের প্রবর্তিত মানহাজ বা নীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন।
সুনানে নাসাঈর  সত্যায়ন ও মূল্যায়ন : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর সংকলিত ‘সুনানুল কুবরা’-কে  পরিমার্জন ও সংক্ষেপ করে ‘সুনানুছ ছুগরা’ তথা ‘সুনানে নাসাঈ’ সংকলন করে দৃঢ়তার  সাথে বলেছেন, كتاب  السنن كله  صحيح وبعضه معلول والمنتخب المسمى  بالمجتبى صحيح كله- ‘সুনানুল কুবরা’-এর সব হাদীছ ছহীহ। তবে কিছু  কিছু হাদীছের সনদ ত্রুটিযুক্ত। আর ‘মুজতাবা’ তথা ‘সুনানে নাসাঈ’তে নির্বাচিত সব  হাদীছই ছহীহ’।
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ ইবনে রুশাইদ (মৃঃ ৭২১ হিঃ) বলেন, ‘সুনান পর্যায়ে  হাদীছের যত গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়েছে, তন্মধ্যে এ গ্রন্থটি অভিনব রীতিতে প্রণয়ন করা  হয়েছে। আর এর সজ্জায়নও চমৎকার। এতে বুখারী ও মুসলিম উভয়ের রচনারীতির মধ্যে সমন্বয়  করা হয়েছে। সাথে সাথে হাদীছের ‘ত্রুটি’ও এতে বর্ণনা করা হয়েছে।
আবু যাহূ ‘আল-হাদীছ  ওয়াল মুহাদ্দিছূন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মোদ্দাকথা, ‘মুজতাবা’ তথা ‘সুনানে নাসাঈ’তে অনুসৃত  ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর শর্ত ছহীহাইনের পর সবচেয়ে বেশী সুদৃঢ় শর্ত। যা তাঁকে  মুহাদ্দিছগণের দৃষ্টিতে মহান করেছে। তিনি আরো বলেন, ‘মুজতাবা  তথা সুনানে নাসাঈতে যঈফ এবং সমালোচিত রাবী বর্ণিত হাদীছ খুবই কম রয়েছে। এ গ্রন্থের  মর্যাদা ছহীহাইনের পরে এবং এটি সুনানে আবূ দাঊদ ও সুনানে তিরমিযীর চেয়ে অগ্রগণ্য।
হাফেয আবুল হাসান  মু‘আফেরী বলেন, ‘মুহাদ্দিছগণের  বর্ণিত হাদীছ সমূহের প্রতি যখন তুমি লক্ষ্য করবে, তখন এ কথা বুঝতে পারবে যে, ইমাম  নাসাঈ (রহঃ)-এর সংকলিত হাদীছ অপরের সংকলিত হাদীছের তুলনায় বিশুদ্ধতার অধিক  নিকটবর্তী’।
তাজুদ্দীন সুবকী স্বীয় পিতা তাকীউদ্দীন সুবকী ও উস্তায হাফিয যাহাবী থেকে  বর্ণনা করেছেন,وان سننه أقل السنن  بعد الصحيحين حديثا ضعيفا- ‘ছহীহাইনের পর অন্যান্য সুনান  গ্রন্থ সমূহের চেয়ে সুনানে নাসাঈতে কম সংখ্যক যঈফ হাদীছ রয়েছে’।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ ইবনু মাত্বার  আয-যাহরানী বলেন, ‘মোদ্দাকথা হ’ল, ছহীহাইন তথা বুখারী-মুসলিমের পর অন্যান্য সুনান  গ্রন্থের তুলনায় ‘সুনান নাসাঈ’-তে যঈফ হাদীছ ও সমালোচিত রাবী কমই আছে। এর নিকটবর্তী  হ’ল সুনানে আবূ দাঊদ ও তিরমিযী। অন্যদিকে সুনান ইবনু মাজাহ তার বিপরীত’।
হাদীছ গ্রহণে ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর শর্তাবলী :
১. ছহীহ হাদীছের প্রধান দু’টি গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিমে যেসব হাদীছ সন্নিবেশিত হয়েছে সেসব সনদসূত্রে বর্ণিত হাদীছ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
২. প্রধান হাদীছ গ্রন্থদ্বয়ে হাদীছ গ্রহণের যে শর্ত অনুসৃত হয়েছে তাতে উত্তীর্ণ সকল হাদীছই গ্রহণযোগ্য।
৩. যেসব হাদীছ সর্বসম্মতভাবে ও মুহাদ্দিছীনের ঐক্যমতের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত তা গ্রহণীয় নয়। পক্ষান্তরে হাদীছের যেসব সনদ ‘মুত্তাছিল’ তথা ধারাবাহিক বর্ণনা পরম্পরাসূত্রে কোন বর্ণনাকারীই উহ্য নয়, তা অবশ্যই গ্রহণীয়। মূল হাদীছ ছহীহ হ’লে এবং ‘মুরসাল’ (مُرْسَلٌ) কিংবা ‘মুনকাতি‘ (مُنْقَطِعٌ) না হ’লে তাও গ্রহণযোগ্য।
৪. চতুর্থ পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের মধ্যে উত্তম বর্ণনাকারী হ’তে বর্ণিত হাদীছও গ্রহণযোগ্য। এসব শর্ত ইমাম নাসাঈ (রহঃ) ও ইমাম আবূদাঊদ (রহঃ)-এর নিকট সমভাবে গৃহীত। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর আরোপিত শর্ত ইমাম আবূদাঊদ অপেক্ষাও অধিক শক্তিশালী। ইমাম নাসাঈ (রহঃ) হাদীছ গ্রহণের ব্যাপারে বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাদের অবস্থা সম্পর্কে অধিকতর খোঁজ-খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করেছেন। এ কারণেই ইমাম নাসাঈ (রহঃ) এমন অনেক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করেননি, যাদের নিকট থেকে ইমাম আবূদাঊদ (রহঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীছ গ্রহণ করেছেন।
এ সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘এমন অনেক বর্ণনাকারী আছেন, যাদের নিকট থেকে ইমাম আবুদাঊদ ও তিরমিযী (রহঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁদের বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’তে বিরত থেকেছেন; বরং বুখারী ও মুসলিমের একদল বর্ণনাকারীর নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা থেকেও ইমাম নাসাঈ (রহঃ) বিরত থেকেছেন। হাফেয আবু আলী আন-নিসাপুরী বলেন,للنسائي شرط في الرجال أشد من شرط البخاري ومسلم ‘হাদীছ গ্রহণে ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর শর্ত ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহঃ)-এর শর্তের চেয়েও কঠিন’।
ড. আবু জামীল আল-হাসান বলেছেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে, আবু আলী আন-নিসাপুরীর উক্ত কথা অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি। কেননা হাদীছ গ্রহণে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তাবলী শীর্ষস্থানীয়’।
আল্লামা হাযেমী (রহঃ) বলেন, ‘ইমাম আবুদাঊদ ও নাসাঈ (রহঃ) প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের রাবীদের হাদীছ গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা চতুর্থ স্তর অতিক্রম করেননি’।
সুনানে নাসাঈর বৈশিষ্ট্য :
সুনানে নাসাঈর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে অপরাপর হাদীছ গ্রন্থ থেকে পৃথক স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। নিম্নে সুনানে নাসাঈর কতিপয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হ’ল।-
১. প্রায় তাকরার বা দ্বিরুক্তিমুক্ত : কুতুবুস সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় সুনানে নাসাঈতে তাকরার তথা পুনঃউল্লিখিত হাদীছের সংখ্যা কম। এতে তাকরার হাদীছ নেই বললেই চলে।
২. হাদীছের দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা : এ গ্রন্থে কোন কোন স্থানে হাদীছের দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন একটি হাদীছ উল্লেখ করার পর তিনি বলেন,الركس : طعام الجن ‘আর-রিকসু’ অর্থাৎ জিনের খাদ্য। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, لاَ تُزْرِمُوْهُ  ‘তার পেশাবে বাধা দিও না’। এর অর্থে তিনি বলেন, لاَ تَقْطَعُوْا عَلَيْهِ অর্থাৎ তার পেশাব বন্ধ করে দিও না।
৩. অধিক রাবী সম্বলিত হাদীছ : ইমাম নাসাঈ স্বীয় গ্রন্থে শক্তিশালী ও ছহীহ সনদের ভিত্তিতে হাদীছ সন্নিবেশিত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি দশজন রাবী বিশিষ্ট হাদীছও উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি একটি হাদীছ উল্লেখ করে বলেন,ما أعرف إسنادا أطول من هذا ‘এর চেয়ে দীর্ঘ সনদ বিশিষ্ট হাদীছ আমার জানা নেই।
৪. ফিক্বহী বিন্যাস : এ গ্রন্থের হাদীছগুলো ফিক্বহী তারতীব অনুযায়ী সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এ গ্রন্থ শুরু হয়েছে ‘পবিত্রতা’ অধ্যায় দ্বারা এবং শেষ হয়েছে ‘পানীয় দ্রব্যের বর্ণনা’ দ্বারা। অধ্যায় বিন্যাসে মৌলিক অর্থের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
৫. সকল বিষয়ের হাদীছের সন্নিবেশ : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) এ গ্রন্থে জীবনের সকল দিক সম্পর্কিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখায় হাদীছ সন্নিবেশিত করেছেন।
৬. ইলালুল হাদীছ বর্ণনা : এ গ্রন্থে ইমাম নাসাঈ (রহঃ) পৃথকভাবে শিরোনাম নির্ধারণ করে হাদীছের ইল্লত (ত্রুটি) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হাদীছের ত্রুটি বর্ণনার পর তিনি সঠিকটা উল্লেখ করেছেন। মতানৈক্যের ক্ষেত্রে অধিক প্রাধান্যযোগ্য বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
৭. অনুচ্ছেদ রচনা : সুনানে নাসাঈর হাদীছের অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদগুলো ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত। এ গ্রন্থের অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদের শিরোনাম অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য। হাদীছ ও শিরোনামের মধ্যে সাযুজ্য বিদ্যমান। এ গ্রন্থে তরজমাতুল বাব সংযোজনে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর ফিক্বহী ধারাকে অনুসরণ করা হয়েছে।
৮. স্বল্পসংখ্যক তা‘লীক হাদীছ : এ গ্রন্থে ইমাম নাসাঈ (রহঃ) অতি স্বল্প সংখ্যক তা‘লীক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থে প্রায় ১৮০টি তা‘লীক হাদীছ উল্লিখিত হয়েছে।
৯. হাদীছের মান ও স্তর বর্ণনা : এ গ্রন্থে কখনো কখনো হাদীছের স্তর ও মান বর্ণিত হয়েছে। যেমন একটি হাদীছ উল্লেখ করে তিনি বলেন, هذا حديث منكر ‘এ হাদীছটি মুনকার বা প্রত্যাখ্যাত’।[15] অনুরূপভাবে আরেকটি হাদীছ উল্লেখ করে তিনি বলেন, حديث يحيى بن سعيد هذا إسناده حسن، وهو منكر وأخاف أن يكون الغلط من محمد بن فضيل. ‘ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বর্ণিত এই হাদীছের সনদ হাসান। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যাত। আমি আশংকা করছি যে, মুহাম্মাদ ইবনে ফুযাইলের ভ্রান্তি রয়েছে’।
কখনো তিনি রাবীর ত্রুটি বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, الأوزاعي لم يسمع هذا الحديث من الزهري وهذا حديث صحيح قد رواه يونس، عن الزهري. ‘আওযাঈ (রহঃ) এই হাদীছ যুহরী থেকে শুনেননি। এই হাদীছটি ছহীহ, যা ইউনুস যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন’।
১০. সনদের অবস্থা বর্ণনা : এতে মুত্তাছিল, মুনকাতি‘, মুরসাল ইত্যাদি অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন একটি হাদীছ উল্লেখ করে তিনি বলেন, مخرمة لم يسمع من أبيه شيئا ‘মাখরামাহ তার পিতা থেকে কিছুই শুনেনি’।[18] অন্যত্র একটি হাদীছ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, الحسن، عن سمرة كتابا، ولم يسمع الحسن من سمرة إلا حديث العقيقة، ‘হাসান সামুরা (রাঃ)-এর সংকলন থেকে হাদীছটি গ্রহণ করেছেন। আর হাসান সামুরা থেকে কেবল আক্বীক্বা সম্পর্কিত হাদীছটিই শুনেছেন’।
১১. অধিক সনদ উল্লেখ : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) কোন হাদীছের একাধিক সনদ কিংবা একই হাদীছের বিভিন্ন সনদ থাকলে তাও উল্লেখ করেছেন।
১২. আহকাম সম্বলিত হাদীছ : ইমাম নাসাঈ (রহঃ) স্বীয় সুনান গ্রন্থে আহকাম সম্বলিত হাদীছ সন্নিবেশিত করেছেন। ড. তাকীউদ্দীন নাদভী বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে আহকাম সম্বলিত যে সকল হাদীছ ছহীহ সাব্যস্ত হয়েছে সে সকল হাদীছ স্বীয় সুনানে নাসাঈতে একত্রিত করা ইমাম নাসাঈ (রহঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল। যাতে সেগুলো দ্বারা ফক্বীহগণ দলীল গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে তিনি হাদীছ ও ফিক্বহের মাঝে সমন্বয় সাধন করেছেন’।